ফাতেমা তাবাসুম
ভারতের বন্যার পানি বাংলাদেশে প্রবেশের দৃশ্য দাবিতে তিন দেশের ভিডিও
ফাতেমা তাবাসুম
ভারত থেকে বাংলাদেশে বন্যার পানি ঢুকছে দাবিতে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বেশকিছু ভিডিও ছড়িয়েছে। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে এই রকম চারটি ভিডিও পাওয়া গেছে যেগুলোর কোনোটিই বাংলাদেশে পানি প্রবেশের ঘটনা নয়। এর মধ্যে চীন, ইকুয়েডর ও ভারতের অভ্যন্তরীণ একটি ভিডিও রয়েছে। ভারতের ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করে সরাসরি দাবি করা হয়: “ভারত থেকে পানি আসার কারণে সিলেটের এক পরিবার দেখেন কি অবস্থা সিলেটে….”। এ ঘটনাটি ১ জুলাই পাঁচ জনের প্রাণহানির তথ্য দিয়েছে ভারতের গণমাধ্যম।
লোনাভালা, ভারত
ভারতের লোনাভালার পাহাড়ি ঢলের ভিডিওটি ১ জুলাই ফেসবুকে শেয়ার করেন একজন ব্যবহারকারী। ক্যাপশনে লেখা হয় “আওয়ামিলীগ ও সমর্থকদের বন্ধু রাস্ট্র ভারত থেকে পাহাড়ি ঢল এবং তিস্তার ৪৪ ব্যারেজ খুলে দেওয়া হয়েছে তাই সিলেটে পানি বাড়ছে আবারো বন্যার পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা”। ভিডিওটি ফেসবুকে এক হাজারের বেশি বার দেখা হয়। একই ভিডিও রিল আকারে শেয়ার করতে দেখা যায় আরেক ব্যবহারকারীকে। তিনি ক্যাপশনে লিখেন “ভারত থেকে কিভাবে পানি চলে এসে বাংলাদেশে”। ভিডিওটিতে দেখা যায়, প্রবল বেগে নামা পাহাড়ি ঢলে আটকা পড়েছেন নারী-শিশুসহ নয় থেকে ১০ জন মানুষ; যাদের বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন অদূরে উপস্থিত আরও কয়েকজন ব্যক্তি।
একই ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায় আরও একটি ফেসবুক প্রফাইলে। ক্যাপশনে লেখা: “আল্লাহ আপনি সিলেটবাসীদের উপর রহম করুন।। ভারত থেকে পানি আসার কারণে সিলেটের এক পরিবার দেখেন কি অবস্থা।।। এরপরেও আমার দেশের কিছু মন্ত্রী আছে যারা বলবে ভারতের সাথে আমাদের স্বামীর স্ত্রীর সম্পর্ক।।😡😡😡😡 আসেন আমরা সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ যেন প্রিয় সিলেটবাসীদেরকে রহম করুন হেফাজত করুন।।”
এই তিনজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে দুইজনের ফেসবুক প্রোফাইল (১, ২) বলছে তারা বাংলাদেশি। একজনের কোনো তথ্য দৃশ্যমান নেই। মূল ভিডিওটি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনে জেলার একটি পাহাড়ি এলাকায় ধারণ করা। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ঘটনাটিকে বলছে “লোনাভলা ওয়াটারফল ট্র্যাজেডি (Lonavala waterfall tragedy)।” মহারাষ্ট্র, পুনে বা লোনাভলা কোনোভাবেই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নয়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতীয় অংশে থাকা রাজ্য বা অঞ্চলগুলো হলো পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম (সূত্র: বর্ডার ম্যানেজমেন্ট: ডিলেমা অফ গার্ডিং দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ বর্ডার)। মূল ঘটনাটির সঙ্গে বাংলাদেশে ভারতের পানি প্রবেশের কোনো সংযোগ নেই।
টাইগার লিপিং গর্জ, চীন
গত ২৩ জুন ফেসবুকে শেয়ার করা একটি রিলে দেখা যায় প্রবল বেগে নেমে আসছে পাহাড়ি ঢল। একজনকে বলতে শোনা যায়, “দেখেন ভাই দেখেন! ইন্ডিয়াত থেকে বন্যার পানি কীভাবে বাংলাদেশে ঢুকতেছে।” ভিডিওটি শেয়ার হয়েছে ছয় হাজার বারের বেশি; রয়েছে বেশি ৫০ হাজারের বেশি মানুষের প্রতিক্রিয়া। গত ২১ জুন ইউটিউবে দেওয়া একই ভিডিওতে দাবি করা হয়, এটি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের “বিধ্বংসী বন্যার” দৃশ্য। এই একই ভিডিও ভিন্ন ভিন্ন স্থানের দাবিতে ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব এবং পিন্টারেস্টেও খুঁজে পাওয়া যায়।
ডিসমিসল্যাব রিভার্স ইমেজ সার্চ ও স্যাটেলাইট ম্যাপের মাধ্যমে যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে যে ভিডিওতে দৃশ্যমান স্থানটি চীনের বিখ্যাত টাইগার লিপিং গর্জ নামক পর্যটন কেন্দ্রের। ম্যাপে স্থানটির ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ বা দৃশ্যেরও খোঁজ মেলে। পর্যটন কেন্দ্রটি চীনে “হু তিয়াও জিয়া (Hutiao Xia– 虎跳峡)” নামে পরিচিত। চীনের ইউনান প্রদেশের এ পর্যটনকেন্দ্রটিতে মানুষ ভিড় জমায় জিনশা নদীর প্রবল পানির স্রোত দেখতে। যার অনেক ভিডিও ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব ও ফেসবুকের ভ্যারিফাইড চ্যানেলে খুঁজে পাওয়া যায়।
ইকুয়েডর
গত ১৯ জুন ফেসবুকে প্রবল ঢলের একটি ভিডিও দিয়ে ক্যাপশন করা হয় “ভারত থেকে আসা পানি বাংলাদেশে ডুকছে ভয়াবহ দৃশ্য।” রিভার্স ইমেজ সার্চে একটি ইনস্টাগ্রাম ভিডিও পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। অ্যাকাউন্ট যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি ইকুয়েডোরের একটি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল টিসিটেলিভিশন (TCTelevsion)– এর ভেরিফাইড ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট। এছাড়া কিওয়ার্ড সার্চে একই ক্লিপ ফেসবুকে ইকুয়েডোরের একজন স্থানীয় ব্যক্তির প্রোফাইলে পাওয়া যায়। ১৮ জুনের টিসিটেলিভিশনের প্রতিবেদনটিতে এ বলা হয়, প্রবল বর্ষণে দেশটি ভূমিধস ও বন্যার শিকার হয়েছে এবং এরই একটি দৃশ্য ভিডিওতে রয়েছে।
গত ৩০ জুন একজন একটি ছবি ফেসবুকে দিয়ে দাবি করেন, “অবশেষে ঢুকতে শুরু করেছে ভারতের পানি.. কে বলেছে ভারত আমাদের বন্ধু নয়….? …বন্দেমাতরম – জয়বাংলা।” যাচাইয়ে দেখা যায়, ছবিটি বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কপোতাক্ষ নদের একটি বাঁধ ভেঙ্গে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের এক গ্রাম প্লাবিত হবার দৃশ্য। ২০২০ সালের আগস্টে ঘটেছিল এই ঘটনা। ছবিটি তখন দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যার জন্য ফারাক্কা দায়ী দাবিতে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম টিকটকে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পাঞ্চেত বাঁধের ২০১৭ সালের একটি পুরোনো ভিডিও ভাইরাল হতে দেখা যায়। এ সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন (ইউটিউব প্রতিবেদন) প্রকাশ করেছে দৈনিক আজকের পত্রিকা। এছাড়াও “ঈদের আগে সাঁতরে ঢুকছে ভারতের অসংখ্য গরু” –এমন দাবিতে একটি ভিন্ন ও অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও গত ঈদের আগে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়াতে দেখা যায়। এ নিয়ে সেসময় ডিসমিসল্যাবে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন–ও প্রকাশ পায়।