তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
যেভাবে স্যাটায়ারকে মেয়র তাপসের উক্তি ভাবলেন নেটিজেনরা
This article is more than 1 year old

যেভাবে স্যাটায়ারকে মেয়র তাপসের উক্তি ভাবলেন নেটিজেনরা

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি সংবাদ প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট (১, , ৩, , , ) নিয়ে বিতর্ক ছড়াতে দেখা গেছে। স্ক্রিনশটে গাছ কাটা সংক্রান্ত একটি উক্তি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বক্তব্য দাবি করে প্রচারিত হয়। তবে যাচাইয়ে দেখা যায় উক্তিটি মেয়র তাপসের নয়, বরং এটি ছিল একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত স্যাটায়ার। 

মূল ঘটনার সূত্রপাত গত মাসে রাজধানীতে সড়ক বিভাজকের গাছ কেটে ফেলার ঘটনা থেকে। সৌন্দর্যবর্ধনের যুক্তি দেখিয়ে ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোড সড়ক থেকে মেহগনি, নিমসহ বেশ কিছু ফুল ও ফল গাছ কেটে ফেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। নাগরিক সমাজসহ পরিবেশবাদীরা বিষয়টির কঠোর সমালোচনা করেন এবং গাছ কাটার বিপক্ষে বিভিন্ন প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজিত হয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ মে ডেইলি স্টারে রম্য পাতা ‘স্যাটেয়ারডে’তে ‘কাটিং ট্রিজ টু মেক ওয়ে ফর এয়ার’ নামে একটি স্যাটায়ার প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের ২৪ দিন পর, গত  ৭ জুন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস স্যাটায়ার প্রতিবেদনটিকে মানহানিকর দাবি করে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠান। পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক ও স্যাটায়ার লেখকের বিরুদ্ধেও একই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। 

মেয়র তাপসের মানহানির নোটিশ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম প্রতিবেদন (, ,, ) প্রকাশ করে।

যাচাইয়ে দেখা যায়, ফেসবুকে ভাইরাল স্ক্রিনশটটি যমুনা টিভি অনলাইনে ৭ জুন প্রকাশিত “ক্ষতিপূরণ চেয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মেয়র তাপসের নোটিশ” শীর্ষক প্রতিবেদনের। প্রতিবেদনটিতে স্যাটায়ার বা রম্য রচনার বিষয়টি উল্লেখ না করে সেটিকে দ্য ডেইলি স্টারের নিয়মিত সংবাদ প্রতিবেদন হিসেবে তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়, “গত ১৩ মে ‘কাটিং ট্রিস টু মেক ওয়ে ফর এয়ার’ শিরোনামে ডেইলি স্টারে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, তীব্র গরমের মধ্যে রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ অংশে গাছ কাটার কর্মসূচি নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ নিয়ে পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। 

সেখানে গাছ কাটার বিষয়ে মেয়র তাপস যুক্তি দিয়ে বলেন, রাজধানী ঢাকাকে জঙ্গল মনে হয়। যেখানে-সেখানে অনেক গাছ লাগানো। এগুলো অনেক জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু বাতাস পাওয়া যায় কম। বাতাস চলাচলের জন্য আমাদের অনেক খোলামেলা বড় জায়গা দরকার। আর গাছ কাটা হলে এসব খালি জায়গা দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারবে।

গাছ কর্তন করা হলে নগরীর সৌন্দর্য কমবে কি না, এ নিয়েও ব্যাখ্যা দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র। বলেন, সবক্ষেত্রে কী সবুজ দরকার? উল্টো প্রতিবেদককে রঙের সংজ্ঞা জানা আছে কি না জিজ্ঞেস করে মেয়র তাপস বলেন, সবুজ রঙ ঈর্ষা প্রকাশ করে। ঢাকা শহর কি ঈর্ষার শহর? না।

প্রতিবেদনটির এই অংশের একটি স্ক্রিনশট সামাজিক মাধ্যমে মেয়রের বক্তব্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে, যা আদতে ডেইলি স্টারের ‘কাটিং ট্রিস টু মেক ওয়ে ফর এয়ার’ স্যাটায়ার লেখাটির তৃতীয় ও চতুর্থ অনুচ্ছেদের বাংলা অনুবাদ। 

তবে ডেইলি স্টারের মূল স্যাটায়ার প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিবেদনটির কোথাও মেয়র ফজলে নূর তাপসের নামের উল্লেখ ছিল না। এমনকি যমুনা টিভির প্রতিবেদনে ঢাকাকে জঙ্গল উল্লেখ করে মেয়র তাপসের বক্তব্য দাবি করা হলেও স্যাটায়ারটিতে ঢাকার পরিবর্তে ‘ধোকা দক্ষিণ’ নামের একটি কাল্পনিক নগরীর নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রতিবেদনটিতে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ না থাকায়, সাধারণ পাঠক স্যাটায়ার বক্তব্যকেই মেয়র তাপসের উক্তি হিসেবে ধরে নেয় এবং পরবর্তীতে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ডেইলি স্টার প্রতি শনিবার ১৬ নং পৃষ্ঠায় স্যাটায়ার ডে নামের বিশেষ পাতা প্রকাশ করলেও ১৩ মের ই-পেপারে ১৬ নাম্বার পৃষ্ঠাটি পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, আইনি নোটিশ পাওয়ার পর প্রতিবেদনসহ পুরো পাতাটাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে সামাজিক মাধ্যমে ডেইলি স্টারের ই-পেপার সংস্করণে থাকা প্রতিবেদনটির স্ক্রিনশট পাওয়া যায়।

পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণেও মূল স্যাটায়ারটি পাওয়া যায় না। তবে মেয়র তাপসের আইনি নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে ডেইলি স্টার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “প্রেস ব্রিফিংয়ে রম্য রচনাটিকে একটি ‘রিপোর্ট’ বা ‘কলাম’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সঠিক নয়। এটি একটি রম্য রচনা ছিল। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই ধরনের রম্য রচনা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বেই প্রচলিত ও স্বীকৃত। লেখাটি ডেইলি স্টারের সাপ্তাহিক রম্য পাতা ‘স্যাটায়ারডে’-তে প্রকাশিত হয়েছিল।”

প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত যমুনা টিভি তাদের প্রতিবেদন অন্তত তিনবার হালনাগাদ করে। বিভ্রান্তির বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর গণমাধ্যমটি একটি পৃথক ফুটনোট সংযোজন করে স্যাটায়ারটিকে মেয়রের বক্তব্য ভেবে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। এছাড়া মেয়রের আইনজীবীর আইনি নোটিশে স্যাটায়ারটিকে বারবার সংবাদ হিসেবে উল্লেখ করার কারণে এই ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা। 

তবে মূল আইনি নোটিশের কপি যাচাই করেও দেখা যায়, সেখানে ডেইলি স্টারের লেখাই হুবহু কোটেশন আকারে তুলে দেওয়া হয়েছে যেখানে ঢাকা বা মেয়র তাপসের নামের উল্লেখ নেই। তবে নোটিশে ব্যাখ্যা হিসেবে স্যাটায়ারটিতে ঢাকাকেই কাল্পনিক নগরী ‘ধোকা’ ও মেয়র তাপসের পরিবর্তে ‘ফাপোস’ নাম ব্যবহার করার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে এএফপি’র ফ্যাক্টচেক সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির বলেন, মূলত মিডিয়াতে প্রতিবেদনগুলো যথেষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছে এবং সেসব প্রতিবেদনই এই অপতথ্য ছড়াতে ভূমিকা রেখেছে।

জনমনে প্রতিক্রিয়া

ভাইরাল স্ক্রিনশটটি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার একজন লিখেছেন, “আর কতটা ইরিস্পন্সিবল মন্তব্য হতে‌ পারে….”। আরেক নেটিজেন লিখেছেন, “এটাই সায়েন্স। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার স্টার্টার প্যাক হলো- লজ্জা-শরম আর ব্রেইন দুইটা ফরমালিন দিয়ে বৈয়ামে সংরক্ষণ করে এরপর মাঠে নামা।”

পোস্টগুলোর মন্তব্যের ঘরেও কেউ কেউ মেয়রের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন, কেউ সমালোচনা করেছেন আবার কেউ কেউ মেয়রের বক্তব্য শুনে ফেটে যাচ্ছেন অট্টহাসিতে।

মন্তব্য ঘরে একজন লিখেছেন, ‘গাধা নাকি!’। আরেকজন লিখেছেন, ‘এগুলা কি মুখ দিয়ে বের করে নাকি অন্য কিছু দিয়ে?’ আরেক নেটিজেনের মন্তব্য, ‘ভুল বলেন নাই তো। হাওয়া বেশ ক’রকম হয় বলে আমাদের বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন। তার ওপর ভিত্তি করেই গাছপালা হটিয়ে আমরা অহোরাত্র লু হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা করতে কাজ করছি। প্রয়োজনে সৌদি আরবের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবো।’

এর আগে গত মাসে মেয়র তাপস সাংবাদিকদের বলেন, ‘উন্নয়ন কাজে অনেক সময় গাছ ফেলে দিতে হয়, কেটে ফেলতে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু আমরা তখনই করি, যখন নিতান্তই আর কোনো উপায় থাকে না।’

সংবাদমাধ্যম ও নেটিজেনরা কেন স্যাটায়ারটি ধরতে ব্যর্থ হলো তার ব্যাখ্যা দেন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা ফ্যাক্টওয়াচের পরিচালক ও প্রতিষ্ঠাতা সুমন রহমান। তিনি বলেন, “একটু তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে পুরো ঘটনাটা ঘটেছে কনফারমেশন বায়াসের কারণে। ধানমন্ডিতে গাছ কাটা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর ধারাবাহিক প্রতিবেদন থেকে মানুষ মেয়রের মাঝে সংবেদনশীলতার অভাব খুঁজে পাচ্ছিল। আর সেই পূর্ব ধারণার কারণেই এই স্যাটায়ারের বক্তব্যকে তারা সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছে।”

স্যাটায়ার নিয়ে গণমাধ্যমের আরও যত ভুল

এর আগেও বিভিন্ন সময় স্যাটায়ার থেকে ভুয়া সংবাদ ছড়াতে দেখা গেছে। গত বছর অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বিয়ের আসরে জুতা চুরি নিয়ে থানায় অভিযোগের একটি স্যাটায়ারকে বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ হিসেবে প্রচার করে । এছাড়া “ভোট গুনতে বাংলাদেশের সাহায্য চাইল যুক্তরাষ্ট্র” শিরোনামে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি রম্য প্রতিবেদনও সংবাদ হিসেবে ছড়াতে দেখা যায়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক-সিরিয়া ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দাবি করা হয় – পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ মাওলানা ফজলুর রহমান বলেছেন, মেয়েরা জিন্স পরছে তাই এত ভূমিকম্প হচ্ছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে এই দাবি দফায় দফায় সামাজিক মাধ্যমে ছড়ায়। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, এই উক্তিটির জন্মও স্যাটায়ার প্রতিবেদন থেকেই। স্যাটায়ার থেকে কীভাবে ভুল তথ্য ও ভুয়া খবর জন্ম নেয় এবং টিকে থাকে সে সম্পর্কিত আমাদের বিস্তারিত প্রতিবেদন পড়ুন এখানে

প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে স্যাটায়ার ব্যবহারও নতুন নয়। নাইজেরিয়ান গবেষক জুলিয়া কে উডোফিয়ার মতে, “স্যাটায়ার মূলত হাস্যরসাত্মক হয়ে থাকে, তবে এর উদ্দেশ্য মানুষকে হাসানোর চেয়েও বেশি কিছু। যেমন, কোনো কিছু সংশোধনের চেষ্টা। আর এ কারণেই স্যাটায়ার কখনো কখনো প্রতিবাদের একটি রূপ হয়ে দাঁড়ায়।”

মানহানির অভিযোগে মেয়রের আইনি নোটিশ ঘটনাটি ছড়াতে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে এর উত্তরে সুমন রহমান বলেন,”স্যাটায়ারটি মজার ছলে লেখা হলেও আইনি নোটিশ পাঠানোর ফলে এটি সংবাদমাধ্যমে চলে আসায় পুরো ব্যাপারটি একটি ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে”।

কদরুদ্দীন শিশির বলেন, “গতকালের (৭ জুন) আগে এই ইস্যুতে সামাজিক মাধ্যমে কোনো পোস্ট খুঁজে পাইনি। এর অর্থ হলো, নোটিশের খবর সংবাদমাধ্যমে আসার আগে ইস্যুটি নিয়ে জনপরিসরে কোনো আলোচনা ছিল না।”

“মেয়র তাপসের কোনো বক্তব্য স্যাটায়ার নিবন্ধে ছাপায়নি ডেইলি স্টার। কাল্পনিক একটি চরিত্র তৈরি করে সেটির নামে কিছু বক্তব্য ছাপিয়েছে। কিন্তু আইনি নোটিশে সেই কল্পিত চরিত্রের দেওয়া বক্তব্যকে মেয়র তাপস তার নিজের বক্তব্যের ‘বিকৃতি‘ হিসেবে তুলে ধরেছেন। আর মিডিয়াও যাচাই বাছাই ছাড়া সেটি সেভাবেই প্রচার করেছে! ফলে স্যাটায়ারটি নিয়ে আগে খুব বেশি আলোচনা না থাকলেও, পরবর্তীতে তা মেয়রের ভুয়া উক্তি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে,” মন্তব্য শিশিরের।

আরো কিছু লেখা