তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব
ন্যাট্রন লেকে জীবন্ত প্রাণী পাথর বা মমি হয় না
This article is more than 2 months old

ন্যাট্রন লেকে জীবন্ত প্রাণী পাথর বা মমি হয় না

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব

পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়ায় অবস্থিত ন্যাট্রন লেকের পানির সংস্পর্শে এসে জীবন্ত প্রাণী পাথরে পরিণত হয় দাবি করে কিছু পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে ফেসবুকে (, , , , )। এমন দাবিতে বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যমেও (, , , , )। তবে যাচাইয়ে দেখা যায় ন্যাট্রন লেক সম্পর্কিত এসব তথ্য সঠিক নয়। ন্যাট্রন লেকের পানির স্পর্শে এসেই প্রাণীরা পাথর বা মমিতে রূপান্তরিত হয় না, বরং এই লেকে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর বিচরণ ও নিজস্ব বাস্তুব্যবস্থা। মূলত ক্ষার ও লবণ পানির প্রভাবে লেকের চারপাশে মৃত প্রাণীদের দেহ দীর্ঘ সময় সংরক্ষিত থাকে।

ন্যাট্রন লেক সংক্রান্ত এমন ভুল দাবি ফেসবুকে নানাভাবে ছড়াতে দেখা যায় ২০১৩ সাল থেকে। সম্প্রতি “বিজ্ঞান পোস্ট: (মহাকাশ,রসায়ন,জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তি)” নামের একটি গ্রুপে শেয়ার করা পোস্টে দেখা গেছে ৮ হাজারের বেশি রিয়্যাকশন। এবং সেটি শেয়ার করা হয়েছে ৫৮৫ বার। এই গ্রুপে ২০২৩ সালেও একটি পোস্টে করা হয়েছিল এমন দাবি।  

এছাড়া সামাজিক ও গণমাধ্যমে লেকের ধারে ধূসর বিবর্ণ প্রাণীদের পাথরের ভাস্কর্য ও মমির মতো বেশ কিছু প্রতিকৃতির ছবিও দেখা যায়। যাচাই অনুসারে ছবিগুলো চিত্রগ্রাহক নিক ব্র্যান্ডটের তোলা এবং তিনি নিজেই প্রাণীগুলোর মৃতদেহ লেকের ধারে বা গাছের ডালে স্থাপন করে সেগুলোকে জীবন্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। 

উচ্চ পিএইচ মাত্রার অ্যালকেলাইন পানির লেক

সাধারণত স্বাদু পানির কোনো লেকের পিএইচ মাত্রা থাকে ৬-৮ পর্যন্ত। কিন্তু ন্যাট্রন লেকের পানির পিএইচ মাত্রা প্রায় ১০.৫। সোডিয়াম কার্বনেট ও আশেপাশের পাহাড় থেকে আসা খনিজ পদার্থের কারণেই পানির পিএইচ মাত্রা এত বেশি। আফ্রিকা চেকের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন অনুসারে, ন্যাট্রনের বাষ্পায়নের হারও বেশি, যার ফলে লবণের ঘনত্বও দিন দিন বাড়তে থাকে। এমনকি এই হ্রদ থেকে নদী বা সমুদ্রে পানি প্রবাহিত হয় না বলেও লবণাক্ততা কমার সুযোগ নেই।

স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলে অভিযোজিত নয় এমন প্রাণীদের জন্য উচ্চমাত্রার এই ক্ষারীয় লবণ পানি ভয়ানক হতে পারে। কিন্তু লেকের পানির সংস্পর্শে এসেই বিভিন্ন প্রাণী মারা যাচ্ছে, এ ধরনের দাবির কোনো সত্যতা নেই। বরং ন্যাট্রন লেকের রয়েছে নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র। ফ্ল্যামিঙ্গোসহ অন্যান্য পাখিদের আনাগোনা এই লেক ঘিরে। তেলাপিয়া কিংবা জলজ শৈবাল যার উপর ফ্ল্যামিঙ্গো নির্ভরশীল এমন সব প্রাণ ঘিরেই এখানকার জলজ বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারণে ন্যাট্রন লেকের পানি দেখতে রক্তলাল। 

তাহলে প্রাণীগুলো কীভাবে মারা গেছে?

২০১৩ সালে ডেইলি স্টার ‘Lake that turns them into stones’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চ্যানেল আই অনলাইনে নেট্রন লেক নিয়ে “লেক নেট্রন: যেখানে মমি হয় জীবন্ত বন্যপ্রাণী” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন সংবাদ প্রতিদিনে “জীবন্ত প্রাণীকে করে দেয় পাথর, আজও রহস্যে ভরা তানজানিয়ার ‘খুনি হ্রদ’”, এশিয়া নেটে “এই জলে নামলেই পাথর হয়ে যায় পাখিরা, অদ্ভুত রহস্যে মোড়া নেট্রন লেক” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তবে বাস্তবে পানির সংস্পর্শে এসে প্রাণীদের পাথর বা মমিতে পরিণত হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।

বিভিন্ন পোস্ট ও প্রতিবেদনে প্রকাশিত ধূসর প্রাণীদের ছবিগুলো ২০১৩ সালে ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার নিক ব্র্যান্ডটের ‘অ্যাক্রস দি র‍্যাভেজড ল্যান্ড’ বইয়ের অংশ। পূর্ব আফ্রিকার বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের নিয়ে প্রকাশিত ব্র্যান্ডটের ট্রিলজি বইয়ের শেষ খণ্ড এটি। ছবিগুলো ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তোলা। 

এনবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্র্যান্ডট বলেছেন, “আমি অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাণীগুলোর দেখা পাই- বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বাদুড় ন্যাট্রন লেকের ধারে ভেসে উঠেছিল। আমি সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে জীবিত প্রাণীর ভঙ্গিতে সাজিয়েছিলাম। যেন দেখে মনে হয় যে তারা নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।”

হাফিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছেন, “কেউই জানে না প্রাণীগুলো আসলে কীভাবে মারা গিয়েছিল। তবে মনে হয় হ্রদের পানিতে প্রতিফলন তৈরি হওয়ায় প্রাণীগুলো বিভ্রান্ত হয়েছিল এবং পানিতে পড়ে গিয়েছিল। এখানে এত উচ্চমাত্রার ক্ষার ও লবণ বিদ্যমান যে এটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার কোডাক ফিল্ম বক্সের কালি শেষ করে ফেলতে পারবে”।

ব্র্যান্ডট বলেন, “ক্ষার ও লবণের কারণে প্রাণীগুলোর মৃতদেহে আস্তরণ পড়ে এবং শুকিয়ে যাওয়ার পর তা সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে”।

ইউনিভার্সিটি অব লিচেস্টারের ইকোলজিস্ট ডেভিড হারপার এনবিসি নিউজকে বলেন, মরদেহ কোথাও পড়ে থাকলে পচে যায়; “তবে লেকের ধারে এগুলোর গায়ে লবণ জমে বলে দেহগুলো অবিকৃত অবস্থায় থাকে,” বলেন তিনি।

অর্থাৎ, নেট্রন লেকের সংস্পর্শে এসে প্রাণীদের পাথর বা মমিতে পরিণত হওয়ার দাবিটি ভুল।

২০২২ সালে আফ্রিকান ফ্যাক্টচেক অরগানাইজেশন আফ্রিকা-চেকও ন্যাট্রন লেকের সংস্পর্শে এসে প্রাণীদের পাথর হয়ে যাওয়ার দাবি খণ্ডন করে প্রতিবেদন প্রকাশিত করে।

আরো কিছু লেখা