ফামীম আহমেদ
ভিডিওটিতে ‘ভীমরুল তার স্বামীকে কবর দিচ্ছে’ বলে করা দাবিটি বিভ্রান্তিকর
ফামীম আহমেদ
‘মহিলা ভীমরুল কবর খুঁড়ে তার মৃত স্বামীকে কবর দিচ্ছে’– এমন এমন দাবি সহকারে একটি ভিডিও বাংলা ও ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে।
সেরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এই প্লাটফর্মগুলোতে: ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, রেডিট, ইউটিউব, টিকটক।
ফেসবুকের এই পোস্টে ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশন দেয়া হয়েছে: “একদল পতঙ্গ বিজ্ঞানী একটি মহিলা ভীমরূল নিরীক্ষণ করছিলেন। দেখা যায় ভীমরূলটি তার মৃত স্বামীকে কবর দিচ্ছে।ভীমরূলটি কবর খনন করার পর, তার স্বামীর মৃতদেহটি পেটে জড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে কবরের কাছে নিয়ে আসে। তারপর তাকে সমাধিস্থ করে…*আশ্চর্যজনক প্রকৃতি!!!*”
বাংলা ভাষায় এই ঘটনাটি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে “একদল পতঙ্গ বিজ্ঞানী”র কথা উল্লেখ থাকলেও ইংরেজি ভাষার পোস্টগুলোতে “একটি চিত্রগ্রাহক দল”কে (A film team) প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ডিসমিসল্যাব অনুসন্ধান করে দেখেছে, দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
প্রথমত, ভিডিওতে দৃশ্যমান দুটি পতঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক সাদৃশ্য নেই। বরং বর্ণ ও গঠনের দিক থেকে তাদেরকে ভিন্ন গোত্রীয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রাণীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা ডিসমিসল্যাবকে জানিয়েছেন, ভিডিওতে দৃশ্যমান পতঙ্গ দুটি ভিন্ন প্রজাতির। এদের একটি ভীমরুল ও আরেকটি ঘুরঘুরে পোকা (Ciccada) বা পঙ্গপাল (Locust)।
ফ্যাক্টচেক
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুটি পতঙ্গের গায়ের গঠন ও রঙ পুরোপুরি ভিন্নরকম।
ভীমরুলটির গায়ের রঙ কালো বা গাঢ় বাদামী, তাদের পেটের বিভিন্ন অংশে রঙিন হলুদ চিহ্ন রয়েছে। অন্যদিকে ভীমরুলটি যে পতঙ্গটি বহন করছে সেটির মাথা সবুজ বর্ণের। দুই পতঙ্গের শারীরিক গঠনেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ভীমরুলের থেকে পোকাটি আকারে বড়। আবার ভীমরুলের চোখটি অন্য পোকার থেকে বড়। পোকাটির পা ভীমরুলের পায়ের থেকে বড় ও মোটা। পোকা দুটি যে একে অপর থেকে আলাদা তা ভিডিও থেকেই স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।
খোলা চোখেও পতঙ্গ দুটিকে ভিন্ন রকম দেখতে মনে হলেও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলেন তা জানতে ভিডিওটি পাঠানো হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশারকে।
ভিডিওটি দেখে তিনি জানান, দুটি পতঙ্গ ভিন্ন প্রজাতির এবং তাদের একটি অন্যটিকে নিয়ে যাচ্ছে মূলত ভবিষ্যত খাবার হিসেবে সংরক্ষণের জন্য। এর সাথে কোন ধরনের ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’ থাকার দাবিটি নাকচ করেন তিনি।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “সেখানে (ভিডিওটিতে) একটি ওয়াস্প (ভীমরুল) তার খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে একটি গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। যে খাবারটি সে নিয়ে গেছে সেটি এক ধরনের লোকাস্ট বা চিকাডা (Ciccada) যাকে ঘুরঘুরে পোকাও বলে। এই লোকাস্টটি মৃত। তার হাজবেন্ড কিংবা স্বামী নয় এবং এই ওয়াস্প বা হর্নেটটির সাথে এর প্রজাতিরও কোনো মিল নেই। এটি একটি ভিন্ন প্রজাতির লোকাস্ট, যেটি ঐ ওয়াস্পটির খাবার।”
অধ্যাপক বাশার আরও বলেন, “এই লোকাস্টটি মারা গেছে এবং এটিকে মাটির নিচে রাখা হচ্ছে যা সে পরে খাবার হিসেবে ব্যবহার করবে। এই মরা প্রাণীটির উপর সে ডিম পাড়বে। এই ডিম থেকে যে লার্ভা বের হবে সেগুলো এই মরা পোকাটিকে খাবার হিসেবে ব্যবহার করে বেড়ে উঠবে। এ কারণেই এটি (ভীমরুলটি) মরা পোকা মাটির মধ্যে লুকিয়ে রাখছে।”
ভীমরুলের বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে খাবার গর্তে লুকিয়ে রাখার অনুশীলনের বিষয়টি নিয়ে “দ্য নিউইয়র্ক টাইমস”-এর একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে যার মূল বক্তব্যের সাথে প্রফেসর কবিরুল বাশারের ব্যাখ্যার মিল রয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে, ভীমরুল মৃত পোকার উপর তার ডিম পাড়ে, যেন লার্ভাগুলো পরবর্তীতে বেড়ে উঠার জন্যে পর্যাপ্ত খাবার পায়।
“এরপর ভীমরুল ঘুরঘুরে পোকাটিকে তার গর্তে জমা করে এবং সরাসরি তার শিকারের উপর একটি ডিম পাড়ে। ভীমরুলটি লার্ভা থেকে স্ত্রী ভীমরুল বেড়ে উঠার জন্যে তার গর্তে দুটি বা তিনটি ঘুরঘুরে পোকা এবং পুরুষ ভীমরুলের বেড়ে উঠার জন্যে তার গর্তে শুধুমাত্র একটি পোকা সরবরাহ করে থাকে। লার্ভার বেঁচে থাকা এবং বেড়ে উঠার জন্যে এই তাজা খাবার উৎস হিসেবে গর্তে ঘুরঘুরে পোকা রাখে। লার্ভা তার খাবারের সেলফ লাইফ বাড়ানোর জন্যে তার শিকারের স্নায়ুতন্ত্র ভক্ষণ করতে বিরত থাকে। শীতকাল গর্তে অতিবাহিত করার পর যখন আবহাওয়া উষ্ণ হয়, তখন সিল্কের কোকুন চিড়ে গর্ত থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ভীমরুল বেরিয়ে আসে এবং আবার তাদের এই জীবন চক্র শুরু করে”, বলা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে।
এছাড়াও ভীমরুলের এই প্রবণতাটি একটি ইউটিউব ভিডিওটিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অর্থাৎ, ভাইরাল ভিডিওটির ক্যাপশনে মহিলা ভীমরুল তার মৃত স্বামীকে কবর দিচ্ছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটি বিভ্রান্তিকর। বরং দেখা যাচ্ছে, ভীমরুল ও মৃত পোকা এ দুটি ভিন্ন প্রজাতির।
একই বিষয়ে ভারতীয় ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা ফ্যাক্টক্রিসেন্ডো এর আগে ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
দাবিটি ছড়িয়ে পড়ার ধরন ও অনলাইনে প্রতিক্রিয়া
২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই ভিডিও এবং দাবি সম্বলিত বাংলা ভাষায় ২৪টি ও ইংরেজি ভাষায় ৭২টি পাবলিক ফেসবুক পোস্ট পাওয়া গেছে।
এছাড়াও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরাও এই ভিডিওটি (১, ২) শেয়ার করেছেন। রেডিট ফোরামে ভিডিওটি পাওয়া গেছে।
ইংরেজি ভাষায় ইউটিউবে (৩, ৪, ৫) ও টিকটকে (৬, ৭) ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছে। এমনকি লিংকডইনেও এই ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে।
সাধারণ ব্যবহারকারীদের অনেকে ভিডিওটি দেখে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আবার অনেকে কমেন্টে ভিডিওর দাবিটির ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।