ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
ফেনীতে বন্যায় লাশ ভাসছে দাবীতে একাধিক সাজানো ভিডিও প্রচার
This article is more than 3 months old

ফেনীতে বন্যায় লাশ ভাসছে দাবীতে একাধিক সাজানো ভিডিও প্রচার

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যার ভিডিও হিসেবে সম্প্রতি লাশ ভেসে বেড়ানোর একাধিক ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হতে দেখা গেছে। এগুলোর মধ্যে আছে সাদা-কালো জামা পরিহিত এক নারীদেহের ভেসে থাকা, লাল রঙের জামা পরিহিত এক নারীর ভেসে থাকা; জলাধারে ভেসে থাকা লাশকে নৌকায় টেনে ওঠানো এবং পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তির পানিতে ভেসে থাকার ভিডিও। কিছু ক্লিপ আলাদাভাবে ছড়াতে দেখা যায়; আবার কিছুক্ষেত্রে সবগুলো যুক্ত করে নতুন ভিডিও সম্পাদনা করেও প্রচারিত হয়। ক্যাপশন ও ভিডিও দেখে ফেনীর সাম্প্রতিক বন্যার পানিতে মরদেহ ভাসছে ধারণা করে ভিডিওতে মন্তব্য ও শেয়ার করেন ব্যবহারকারীরা। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভাইরাল ভিডিও ক্লিপগুলো আসল কোনো ঘটনার নয়, বরং চারটিই সাজানো ভিডিওর অংশ। 

গত ২৭ আগস্ট ‘শ্রাবণ ও শাকিলা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ হতে সম্প্রতি ২৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রচার হতে দেখা যায়। বাংলাদেশি সঙ্গীত ব্যান্ড অড সিগনেচারের “আমার দেহখান” গানটির সঙ্গে মোট চারটি ভিন্ন ভিন্ন ক্লিপ সম্পাদিত করে ভিডিওটি বানানো। “এই বন্যায় কত মায়ের বুক খালি হলো… 💔😥” দাবিতে ছড়ানো ভিডিওটি ফেসবুকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার বার দেখা হয়েছে। ভিডিওটি শেয়ার হয়েছে প্রায় ২২১ বার। একই দাবিতে ফেসবুকে বেশ কিছু পোস্ট (, , ) শেয়ার করতে দেখা যায়। সরাসরি “ফেনীতে এই বন্যায় কত মায়ের বুক খালি হলো। #ফেনী_বন্যা” দাবিতেও “ফেনী সরকারী কলেজ” নামের ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি ছড়াতে (, ) দেখা যায়। 

২৭ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে ব্যবহার করা সাদাকালো পোশাক পরা মরদেহের ভেসে থাকার প্রথম ক্লিপটি ইতিপূর্বেও এককভাবে ভিন্ন দাবিতে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হতে দেখা গিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার পাগলা বাজার নদীতে ধর্ষণের পর এক হিন্দু নারীর লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে– এমন দাবিতে এক্সের একাধিক হ্যান্ডেল (১১ আগস্ট, ১৩ আগস্ট) থেকে ভিডিওটি শেয়ার হতে দেখা যায়। ফেসবুকের এ সংক্রান্ত বেশিরভাগ ভিডিও ১১ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে পোস্ট করা হয়। তবে গণমাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের কোনো হিন্দু নারী ধর্ষণ বা লাশ খুঁজে পাওয়ার সংবাদ পাওয়া না যাওয়ায় ডিডিওটির সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি। রিভার্স ইমেজ সার্চে সবচেয়ে পুরোনো যে পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায় তা ছিল এক্সে (সাবেক টুইটার), গত ১১ আগস্ট তারিখে পোস্ট হওয়া। তবে ফেনী জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল ২০ আগস্টের পর, ফেনীর বন্যার অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ এই ভিডিওটির সঙ্গে কোনোভাবেই ফেনী জেলার বন্যার কোনো যোগসূত্র নেই।

এছাড়া ৬ সেকেন্ডের লাল রঙের জামা পরিহিত নারীর ভিডিও ক্লিপটিও এর আগে ছড়াতে দেখা গিয়েছিল। ফেনীর বন্যার দাবিতে ভিডিওটি ফেসবুক, ইউটিউবটিকটকে সম্প্রতি অনেকবার শেয়ার হতে দেখা যায়। সরাসরি “হায়রে বন্যার পানি একটা মেয়ে জীবন কেরে নিলও” দাবিতেও ইউটিউবে ভিডিওটি শেয়ার হতে দেখা যায়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমের নামে খোলা একটি ফেসবুক আইডি থেকেও একই সময়কালে ভিডিওটি শেয়ার হতে দেখা যায়।

ভিডিওটি বেশ সাড়া ফেললে দৈনিক আজকের পত্রিকা এটি নিয়ে একটি ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট প্রকাশ করে। মূলত রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধানে “রেসকিউ হাউস ২৫.০” নামের চীনা ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিওটিসহ একই পোশাকে একই ব্যক্তির একাধিক ভিডিওর সন্ধান পায় আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক টিম। গত ২২ আগস্ট চ্যানেলটিতে “শিক্ষামূলক সাজানো ভিডিও” হিসেবে প্রকাশ করা হয় এটি। 

জলাধারে ভেসে থাকা লাশকে নৌকায় টেনে ওঠানোর তৃতীয় ক্লিপটির সম্পূর্ণ ভিডিও রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ইউটিউবে খুঁজে পাওয়া যায়। “বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি #shortvideo #funnyvideo … ” ক্যাপশনে গত ২৫ আগস্ট ভিডিওটি এই চ্যানেলে পোস্ট হয়। ভিডিওটির একদম শেষ অংশে দেখা যায় লাশের মত ভেসে থাকা ব্যক্তিটি জীবিত। শেষ অংশে একটি হাসির অডিও ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওর প্রথম অংশকে বিভ্রান্তিকরভাবে ফেনীর বন্যায় লাশ ভেসে আসার দৃশ্য হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।

পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তির পানিতে ভেসে থাকার শেষ ক্লিপটি “আরো একটি লাশ উদ্ধার | ফেনী💔😭 #ফেনী #feni” দাবিতে ইউটিউবেও প্রচার হতে দেখা যায়। “এই বন্যায় কত মায়ের বুক খালি হলো…” দাবিতে প্রচারিত একই ভিডিওর একটি পোস্ট ফেসবুকে দেখা হয়েছে দুই লাখের বেশি সংখ্যক বার। রিভার্স ইমেজ সার্চের সহায়তায় ডিসমিসল্যাব যাচাইয়ে ভিডিওটির আরেকটি বড় ভার্সন খুঁজে পায় টিকটকইউটিউবে। ৭ আগস্ট টিকটকে ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে “হাসবো না কাঁদবো বুঝতেছিনা #fannyvideo” লেখা হয়। ভিডিওটির প্রথম অংশ দেখে পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তিটিকে মৃত মনে হলেও, শেষ অংশে দেখা যায় তিনি জীবিত আছে। একই সঙ্গে ভিডিওটি শেষ হয় একটি হাসির ক্লিপ দিয়ে। অর্থাৎ এখানেও একটি পুরোনো ভিডিওর শুরুর কিছু অংশ কেটে তা বিভ্রান্তিকরভাবে ফেনীর বন্যায় লাশ ভেসে আসার দৃশ্য হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। 

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা প্লাবিত হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম গণমাধ্যমকে জানান, দেশের মোট ৭৪ উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪১টি ইউনিয়ন। আচমকা বন্যায় ১১টি জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯ পরিবার। বন্যাকবলিত জেলায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৭ জন বলে জানা যায়। তবে বিভ্রান্তিকরভাবে প্রচারিত ক্লিপগুলোর একটিও এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। চলতি বন্যার দৃশ্য দাবিতে ইতিপূর্বেও সামাজিক মাধ্যমে পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও প্রচার হতে দেখা গিয়েছে। এ সংক্রান্ত একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন (, ) প্রকাশ করেছে ডিসমিসল্যাব। 

আরো কিছু লেখা