ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
ফেসবুক থেকে লাইক কমেন্ট করে আয়ের নামে আর্থিক প্রতারণা

ফেসবুক থেকে লাইক কমেন্ট করে আয়ের নামে আর্থিক প্রতারণা

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

ফেসবুকে লাইক-কমেন্টের ভিত্তিতে আয় করার প্রলোভন দেখিয়ে নতুন ধরনের প্রতারণার বিজ্ঞাপন চলতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিকাশের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটফেসবুক পেজে এ ধরনের কোনো প্রচারণার তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। মেটার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুক পেজেও এ ধরনের কোনো অফার দেওয়া হয়নি। কিন্তু মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে এই বিষয়ক এক হাজার ২০০-র অধিক বিজ্ঞাপন চালু ছিল, যা ৮টি ভিন্ন ভিন্ন পেজ থেকে পরিচালিত হয়েছে।

“ফেসবুক থেকে আয় করুন” লিখে মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে সার্চ করলে দেখা যায় অন্তত ৮টি পেজ থেকে ফেসবুকে ২৯ অক্টোবর থেকে ১ হাজারেরও বেশি বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে। বিজ্ঞাপনে যুক্ত লিংকে প্রবেশ করলে ব্যবহারকারীকে এটি সুরক্ষিত নয় এমন একটি ওয়েবপেজে নিয়ে যায়। সেখানে ফেসবুকের একটি লোগো ব্যবহার করে “ফেসবুক থেকে আয় করুন” শিরোনাম দেখা যায়। এর নিচেই উল্লেখ থাকে, “প্রিয় গ্রাহক, আপনি গত৩ বছর ১১ মাস ১৩ দিন  যাবৎ ফেসবুক ব্যবহার করছেন। আপনি এই সময়ে ৭৪,৭৩০ ছবিতে লাইক দিয়েছেন, এবং ৫,৫৪০ টি কমেন্ট করেছেন। ফেসবুক মূলত ব্যবহারকারীদের টাকা দিয়ে থাকে লাইক/কমেন্টের ভিত্তিতে। আপনি এখন পর্যন্ত মোট আয় করেছেন ১১,৬৬৭ টাকা।” এ লিংকে থাকা তথ্যগুলোর মাঝে উল্লিখিত সংখ্যাগুলো নির্দিষ্ট নয়। প্রতিবার রিফ্রেশে বা নতুনভাবে প্রবেশে এই দিন, সংখ্যা ও টাকার মান পরিবর্তন হয়। “এই টাকা আপনি কিভাবে উত্তোলন করতে চান?” এমন এক নির্দেশনার ঠিক নিচেই দেয়া থাকে “বিকাশ,” “নগদ” ও “রকেট” এই তিন মুঠোফোন আর্থিক পরিষেবার অপশন। তার ঠিক নিচেই অসংখ্য মন্তব্য দেখা যায়, যেখানে বিভিন্ন ব্যবহারকারী দাবি করছে যে তারা ইতিমধ্যেই এই টাকা পেয়েছে। 

“বিকাশ,” “নগদ” ও “রকেট” এই তিন পরিষেবার মাঝে বিকাশ অপশটি নির্বাচন করলে, এটি ব্যবহারকারীকে অনিরাপদ আরেকটি ওয়েবপেজে নিয়ে যায়। যেখানে বলা আছে ব্যবহারকারীকে টাকা উত্তোলন করতে হলে, “টাকা উত্তোলন ফর্ম” নামক একটি ফরম পূরণ করতে হবে। এ ফরমে ব্যবহারকারীর কাছে– ফেসবুক আইডির নাম, বয়স, পেশা, প্রতিদিন ফেসবুক ব্যবহার করা হয় কি না, বিকাশ নম্বর সচল কি না, এবং বর্তমানে বিকাশ অ্যাকাউন্টে কত টাকা রয়েছে– এইসকল তথ্য চাওয়া হয়। 

এক্ষেত্রে, কোনো ব্যবহারকারী “নগদ” পরিষেবাটি বেছে নিলে সাইটটি ব্যবহারকারীকে “ক্রিকিয়া” নামক একটি জুয়ার সাইটে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, “রকেট” পরিষেবাটি বেছে নিলে এটি অকার্যকর একটি সাইটে নিয়ে যায়। আবার “টাকা উত্তোলন ফরম”–এ বর্তমানে বিকাশ অ্যাকাউন্টে কত টাকা রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে একশত টাকার নিচে তথ্য প্রদান করলে, সেক্ষেত্রেও লিংকটি ব্যবহারকারীকে “ক্রিকিয়া” জুয়ার সাইটেই নিয়ে যায়। 

এই ক্ষেত্রে ডিসমিসল্যাব অনুসন্ধানের জন্য বিকাশ অ্যাকাউন্টে কত টাকা রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে ‘১০০’ উল্লেখ করলে দেখা যায়, সাইটটি বিকাশের একটি পেমেন্ট গেটওয়েতে নিয়ে যায়। “সোহেল এন্টারপ্রাইজ” নামের এই বিকাশ পেমেন্ট গেটওয়েতে একটি বিকাশ নাম্বার, পিন ও ওটিপি প্রদান করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১০০ টাকা বিকাশ থেকে পেমেন্ট হয়ে যায়। এখান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটি একটি প্রতারণার ফাঁদ। প্রসঙ্গত, এখানে ১০০ টাকার কম পরিমাণ উল্লেখ করলে পেমেন্ট গেটওয়েতে না নিয়ে জুয়ার সাইটে নিয়ে যায়।

যে ৮টি পেজ থেকে এই লিংক বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করা হয়েছে সেই পেজগুলোতে এই সংক্রান্ত কোন পোস্ট পাওয়া যায় না। তবে কিছু পেজের প্রোফাইল ছবিতে একাধিক ফেসবুক ব্যবহারকারীকে মন্তব্য করতে যায় যে তারা এই পেজের বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়েছে। “বিকাশে বোনাস নিন” নামক পেজে একজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “বোনাস তো দিল না আরো ৫০০ টাকা কাইটা নিল। একই নামের আরও একটি পেজে আরও একজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “সব টাকা কেটে নেয় মিথ্যা এগুলা।” ৮টি পেজের মাঝে ৬টি পেজে মোট ১৩জন অ্যাডমিন রয়েছে। এর মধ্যে ৬জন অ্যাডমিন ভারতের ৪জন ইন্দোনেশিয়ার এবং ৩জন মালয়েশিয়ার বলে জানা যায়। 

এর আগেও চলতি বছরের মে-তে প্রধানমন্ত্রী ও গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ফেসবুকে বিকাশের ভুয়া অফারের বিজ্ঞাপন প্রচার হতে দেখা যায়। ডিসমিসল্যাব এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জুনে ঈদ উপলক্ষে আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে টাকা উপহারের ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিজ্ঞাপনের পেছনে প্রতিদিন বাংলাদেশি টাকায় ৭ লক্ষের বেশি ব্যয় করছিল বলে জানা যায়। জুলাইয়ে বিকাশের ১৬ বছর পূর্তিতে বোনাস দাবিতে ফেসবুকে আরও একটি ভুয়া বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালানো হয়। এ বিষয়ে ডিসমিসল্যাব একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

আরো কিছু লেখা