আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ফেসবুকে ৬০০ বিজ্ঞাপন দিয়ে বিকাশের নামে ভুয়া অফার
This article is more than 9 months old

ফেসবুকে ৬০০ বিজ্ঞাপন দিয়ে বিকাশের নামে ভুয়া অফার

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বিকাশ তার গ্রাহকদের ১৪০০ টাকা উপহার হিসেবে দিচ্ছে– এমন একটি পোস্ট সম্প্রতি শেয়ার হতে দেখা গেছে ফেসবুকে (, , )। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভালোবাসা দিবসে বিকাশের ১৪০০ টাকা উপহার তথ্যটি সত্য নয়। বরং প্রতারণামূলক এ ধরনের পোস্টের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হচ্ছে বিকাশ গ্রাহকদের অর্থ। ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারিত হয়েছে এ ধরনের ৬০০টিরও বেশি প্রতারণামূলক পোস্ট। এই বিজ্ঞাপনগুলো চালানো হয়েছে অন্তত ৯টি পেজ থেকে। সবগুলো পেজেরই নাম ছিল একই। “বিকাশ অফার”।

ফেসবুকে বিকাশ অফার লিখে সার্চ দিলে এই নামে অন্তত ২৩টি পেজ পাওয়া যায়। এমন আরও কিছু পেজ আছে– যেগুলো নাম “বিকাশ ফেব্রুয়ারি অফার”, “বিকাশ আপনার অফার”, বা “বিকাশ আজকের অফার” ইত্যাদি। এই পেজগুলোর বেশিরভাগ খোলা হয়েছিল ভিন্ন নামে এবং সেগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। এবং বেশিরভাগ পেজেই কোনো পোস্ট দেখতে পাওয়া যায় না। কোনো কোনো পেজে দেখতে পাওয়া যায় শুধু বিকাশের লোগো সম্বলিত একটি প্রোফাইল পিকচার।

ফেসবুক অ্যাড লাইব্রেরিতে সার্চ দিয়ে দেখা যায়: এই ধরনের ৯টি পেজ থেকে ফেসবুকে ৬০০টিরও বেশি বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে। এর মধ্যে চারটি পেজ বন্ধ দেখতে পাওয়া যায়। বাকি ৫টি পেজ এখনো সক্রিয় আছে। তবে সেগুলোতে কোনো পোস্ট নেই। বিজ্ঞাপনগুলোর সঙ্গে যে লিংকগুলো যুক্ত করা হয়েছে– সেগুলোতে প্রবেশ করলে পাওয়া যায় একই রকম বার্তা। শিরোনামে বলা আছে, “১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বিকাশ দিচ্ছে সকল বিকাশ গ্রাহকদের ১৪০০ টাকা ভালোবাসা উপহার।”

উপহার পাওয়ার নির্দেশনায় বলা হচ্ছে, সেখানে বিকাশে থাকা অর্থের পরিমাণ ও নাম লিখতে হবে। এবং বিকাশে ৩০ হাজারের বেশি টাকা জমা থাকলে অন্য আরেকটি লিংকে তথ্য দিতে হবে। 

এই বিষয়ে বিকাশের সাপোর্ট টিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে, কিছু প্রতারক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে এবং বিভিন্ন ভুয়া বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বিকাশ গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ ও বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বর্তমানে বিকাশ এ ধরনের কোনো অফার ঘোষণা করেনি এবং এ ধরনের অফারগুলোর সঙ্গে বিকাশের কোনো সম্পর্ক নেই।

এরই মধ্যে একাধিক ব্যক্তি এই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে ফেসবুকে পোস্ট ও কমেন্ট করে জানিয়েছেন। একজন ভুক্তভোগী লিখেছেন, “ফেইসবুকে একটা ওয়েবসাইট এ দেখলাম ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বিকাশের সকল গ্রাহক কে ১৪০০ টাকা ভালোবাসা উপহার দিবে। এই মর্মে আমিও লোভে পরে যা যা করা লাগে তাই করলাম এবং পরবর্তীতে দেখলাম আমার বিকাশের অবশিষ্ট ১৫ টাকা ছিল সেটা নিয়ে গেলে। অতএব আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি অন্য কেউ যেন না হয়। সাবধান..!” আরেকজন ভুক্তভোগী এমন একটি পেজের পোস্টে কমেন্ট করেছেন, “এই অফার ভুয়া জীবনে কেহ এই কাজ করবেন না এটা প্রতারণা আমি এই হাতে ধরা পড়েছি বাকিরা যারা পেয়েছে বলছে তারা এই প্রতারণা চক্রের সাথে জড়িত”। প্রতারণামূলক পেজগুলোতে থাকা পোস্টের কমেন্টে আরও কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী এসব পেজ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন বা নিজে প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। 

সম্প্রতি বাংলাদেশী অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদিন দীঘি প্রতারক চক্রের ফোনকলের মাধ্যমে বিকাশ থেকে দেড় লক্ষ টাকা হারান। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশের সাহায্যে তিনি এই টাকা ফিরে পান।   

এইবারই কি প্রথম?

বিকাশ বা অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে অফার-কেন্দ্রিক পোস্ট দিয়ে আর্থিক প্রতারণা এবারই প্রথম নয়। এর আগে, শুধু বিকাশের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন বিশেষ দিবস কেন্দ্রিক ভুয়া অফারের পোস্ট নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে অন্তত ২০টি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিউমার স্ক্যানারের একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিকাশ ২১০০ টাকা উপহার দিচ্ছে এমন একটি ভুয়া তথ্য ফেসবুকে পোস্ট হয়। এবছরও একই দাবি নিয়ে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পোস্ট হতে দেখা যায়। যদিও সেই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে থাকা লিংকে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে না। 

এছাড়াও, ২০২৩ সালে বিকাশকে কেন্দ্র করে প্রতারণামূলক পোস্ট নিয়ে পাঁচটি ভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা থেকে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে (, , , , )। ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা নিয়ে করা এই ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদনগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিন বা ঘটনার উল্লেখ করে এই ধরনের প্রতারণাগুলো করা হয়। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, বিকাশের ১০ বছর পুর্তি, পহেলা বৈশাখ, ছয় কোটি গ্রাহকের মাইলফলক, ঈদুল আজহা। সকল ঘটনায় একটি লিংক দেয়া হয় যেখানে ক্লিক করলে ব্যবহারকারীদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নের উত্তর দিলে অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ প্রতারকদের হাতে চলে যায়।

ফেসবুক এই ব্যাপারে কি বলে?

মেটা অ্যাড স্ট্যান্ডার্ডে বলা হয়েছে, থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকার দ্বারা চিহ্নিত কনটেন্টকে বিজ্ঞাপন আকারে চালানো যাবে না। এছাড়া ভুয়া তথ্য আছে এমন কনটেন্টও মেটা বিজ্ঞাপন হিসেবে দিতে বাধা দেয়।

তবে বিকাশের ভুয়া অফারের মতো প্রতারণামূলক পোস্ট সহজেই ফেসবুকে প্রচার করা যায় বিজ্ঞাপন আকারে। নতুন একটি পেজ তৈরি করে বা পুরোনো পেজের নাম পরিবর্তন করে মুহূর্তেই তৈরি করা যায় ফেসবুক বিজ্ঞাপন। যেমনটি দেখা যায় বিকাশ অফার সংক্রান্ত এসব বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে। ১২ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক অ্যাড লাইব্রেরিতে সার্চ করে দেখা যায়: একটি পেজ থেকে প্রতারণামূলক একই বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে ২০৭ বার। আরও দুইটি পেজ থেকে একই বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে ১৯৯ ও ১৯৮ বার। 

রাজনৈতিক নয়– এমন বিজ্ঞাপন অ্যাড লাইব্রেরিতে দেখতে পাওয়া যায় শুধু সেগুলো সক্রিয় থাকা অবস্থায়। ফলে এ ধরনের আরও কত বিজ্ঞাপন বিভিন্ন সময় প্রচারিত হয়েছে– তার পূর্ণাঙ্গ চিত্রও পাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ বিজ্ঞাপনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেই সেটি অ্যাড লাইব্রেরিতে আর সংরক্ষিত হয় না।

আরো কিছু লেখা