তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন

দিপু চন্দ্র দাসের শেষ ভিডিও বলে বিজেপি নেতারাও ছড়াচ্ছেন ৩২ নম্বরের পুরোনো ঘটনার দৃশ্য
তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন
মৃত্যুর আগে দিপু চন্দ্র দাসের শেষ ভিডিও দাবিতে একাধিক সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটি শেয়ার করে বলা হচ্ছে, দিপু চন্দ্র দাস প্রাণভিক্ষা চাইছেন আর বাংলাদেশ পুলিশ তাকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে হিংস্র জনতার হাতে তুলে দিয়েছে। তবে ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকে দেখা গেছে, দিপু চন্দ্র দাস হত্যার আরও এক মাস আগের ভিন্ন ঘটনার ভিডিও এটি।
সামাজিক মাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও ছড়িয়েছে, যার ক্যাপশনে লেখা, “রাষ্ট্রীয় মদদে: মৃত্যুর আগে শিহরণ জাগানো শেষ ভিডিওতে দিপু দাসকে প্রাণভিক্ষা চাইতে দেখা যায়। বাংলাদেশ পুলিশ তাকে রক্ষা না করে হিংস্র মবের হাতে তুলে দেয়। মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন তথাকথিত “ধর্মনিরপেক্ষ সরকার”-এর অধীনে মবের শাসন সব জয় করেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরবে পাশে দাঁড়িয়ে।”

ভিডিওতে দেখা যায়, একজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি নিজেকে ঢাকা কলেজের ছাত্র বলে দাবি করেন। সেখানে তার উপস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, তিনি মার্কেটে এসেছেন, আন্দোলনে না। পরবর্তীতে ফোনে কারও সাথে কথা বলতে শোনা যায় তাকে, “ডিসি মাসুদ না আসলে আমাকে মাইরা ফেলতো। ডিসি মাসুদ আমাকে সেভ করছে।”
একই ভিডিও আরও এক্স প্রোফাইল (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬) বা পেজ (১, ২) থেকে একই দাবিতে ছড়ানো হয়েছে। একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “যখন একটি দেশ উগ্রবাদীদের দ্বারা পরিচালিত হয় তখন একজন হিন্দুর আর্তনাদ কখনোই শোনা যায় না। মনে রাখবেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষ ও উগ্রবাদীদের প্রতি সহনশীল, তাদের সবার সঙ্গেই একদিন এটা ঘটবে।” এর মধ্যে একটি পোস্ট পৌনে দুই লাখ বার দেখা হয়েছে।
ইনস্টাগ্রামে একই ভিডিও শেয়ার করে একজন লিখেছেন কীভাবে পুলিশ তাকে উগ্রবাদী মুসলিমদের হাতে তুলে দিয়েছে। একই দাবিতে আরও আইডি ও পেজ থেকে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে একটি পোস্ট ৭ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে, প্রতিক্রিয়া পেয়েছে প্রায় ২০ হাজার। প্রাক্তন বিধানসভার সদস্য ও বিজেপির রাজনীতিবিদ সঙ্গীত সোমের ভেরিফায়েড আইডি থেকেও একই দাবিতে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে। ইনস্টাগ্রামে আরও একাধিক একাউন্ট (১, ২) থেকে একই দাবিতে ভিডিওটি ছড়ানো হয়েছে।
বিজেপি নেতা তেজিন্দর পাল সিংহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “দিপু চন্দ্র দাস বারবার কাঁদছিলেন। তিনি ক্রমাগত প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ তাকে উগ্র মুসলিম জনতার হাতে তুলে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।” তার এই পোস্টটি প্রায় ৪০ হাজার বার দেখা হয়েছে।
কিওয়ার্ড সার্চে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। ১৮ নভেম্বর প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের বিভিন্ন দৃশ্যের স্থান, ব্যক্তি, পোশাকের রং-এর সঙ্গে যাচাই করা ভিডিওটি পুরোপুরি মিলে যায়। ভোরের কাগজের ফেসবুক পেজের এই প্রতিবেদনের ক্যাপশনে লেখা, “কি হয়েছিলো ঢাকা কলেজের এই শিক্ষার্থীর সাথে?।।”

এই ঘটনার পর একাধিক ফেসবুক পেজ থেকেও এই ভিডিও এর পরের অংশ পোস্ট করা হয়েছিল। ভিডিওতে (১, ২) দেখা যায়, ডিসি মাসুদ ঐ ব্যক্তিকে রিকশায় তুলে দিচ্ছেন। ১৮ নভেম্বরের পোস্টগুলোর ক্যাপশনেও লেখা, “গতকাল ৩২ নাম্বারে রিক্সা ভাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীকে নিজেই পাঠালেন রমনা জোনের ডিসি মাসুদ আলম।” ডিসি মাসুদ আলম ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার। অন্যদিকে দিপু চন্দ্র দাসের হত্যার ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের ভালুকায়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার দিন ১৭ নভেম্বর (সোমবার) ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আবারও গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। যাচাই করা ভিডিওটি এ দিনেরই ঘটনা, যা দিপু চন্দ্র দাসের হত্যাকান্ডের এক মাস আগের। উল্লেখ্য, দিপু চন্দ্র দাসের হত্যার ঘটনা ঘটেছে গত ১৮ ডিসেম্বর।
প্রসঙ্গত, ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই পোশাকশ্রমিককে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে সংঘবদ্ধভাবে মারধর করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানিয়েছে, ঘটনাটিতে ‘ধর্ম অবমাননার’ কোনো সরাসরি প্রমাণ তারা পায়নি। এদিকে নিহত পোশাকশ্রমিককে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে ‘মব সন্ত্রাসীরা’ হত্যা করার দাবিকে ভুয়া বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন ভালুকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, “পুলিশকে খবরই দেওয়া হয়েছে অনেক দেরি করে”।
অর্থাৎ, বাংলাদেশ পুলিশ দিপু চন্দ্র দাসকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে হিংস্র জনতার হাতে তুলে দিয়েছে বলে ছড়ানো ভিডিওটি এক মাস আগের। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙা কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ভিন্ন ব্যক্তি আটকের ভিডিও এটি।