আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
সম্পাদিত ভিডিও দিয়ে “হিন্দু গণহত্যা আহ্বানের” ভুয়া দাবি প্রচার

সম্পাদিত ভিডিও দিয়ে “হিন্দু গণহত্যা আহ্বানের” ভুয়া দাবি প্রচার

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুইটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশে হিন্দুদের গণহত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বা হিন্দুদের ৭ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। ভিডিও দুইটি ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও জায়গা করে নিয়েছে। সেখানেও ভিডিওগুলো দেখিয়ে হিন্দুদের প্রতি হুমকির ভাষ্য প্রচার করা হয়েছে। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিও দুটির একটিতে সম্পাদনা করে ভিন্ন ঘটনার অডিও যুক্ত করা হয়েছে এবং আরেকটি ভিডিও প্রেক্ষাপট বদলে প্রচার করা হয়েছে, যেখানে হিন্দুদের ৭ দিনের আলটিমেটাম দেওয়ার কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। 

প্রথম ভিডিও

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভয়েজ অফ বাংলাদেশি হিন্দুজ নামের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে একটি সমাবেশের ভিডিও আপলোড করে দাবি করা হয় যে, “বাংলাদেশি জিহাদিরা হিন্দুদের গণহত্যার আহ্বান জানাচ্ছে”। ভিডিওটিতে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, “হিন্দু সন্ত্রাসীদের বলব এটা গুজরাট নয় এটা বাংলাদেশ। আমি হিন্দুদেরকে বলব এটা দিল্লি নয়, এটা বাংলাদেশ। আমি বলব এটা ইন্ডিয়া নয়, এটা শাহজালালের পূণ্যভূমি বাংলাদেশ। এখানে আপনি আমার ভাইকে পিটিয়ে মারবেন আর পূজার নামে দেশীয় অস্ত্র আমাদেরকে দেখাবেন। যদি আমাদের সাথে আপনারা খেলতে চান, মাঠে আসেন আমরা খেলার জন্য প্রস্তুত।” এই ভিডিও পরবর্তীতে শেয়ার হতে দেখা যায় আরও বেশ কিছু টুইটার অ্যাকাউন্ট (, , , , ) থেকে।

ভিডিওটি আসলে কোথায় ধারণ করা হয়েছিল– তা খুঁজতে গিয়ে ফেসবুকের একটি লাইভ ভিডিওর সন্ধান পায় ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, এটি ছিল গত ২৭ সেপ্টেম্বর, রাজধানীর মধ্য বাড্ডার একটি সমাবেশের দৃশ্য। গত আগস্টে ভারতীয় পুরোহিত রামগিরি মহারাজ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করেন এবং সেই বক্তব্যকে বিজেপির বিধায়ক নীতেশ রানে সমর্থন দেন। উক্ত সমাবেশটি আয়োজিত হয়েছিল এই ঘটনার প্রতিবাদে। এই ভিডিওটির কোথাও আলোচ্য বক্তব্যটি শোনা যায় না। এ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেও বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

মধ্য বাড্ডার এই সমাবেশের ভিডিওটির একাংশে সম্পাদনা করে যুক্ত করা হয়েছে মুফতি রেজাউল করিম আবরারের একটি বক্তব্য, যেটি পাওয়া যায় ৩ মে ইউটিউবে আপলোড করা একটি ভিডিওতে। সেখানে তিনি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে উক্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন মন্দিরে আগুন দেওয়ার অভিযোগে গণপিটুনিতে দুই নির্মাণ শ্রমিক হত্যার প্রেক্ষিতে। গত ১৮ এপ্রিল গণপিটুনিতে দুই শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায়।

দ্বিতীয় ভিডিও

সামাজিক মাধ্যমে আরেকটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়েছে যে, ইসলামী সন্ত্রাসী বা উগ্রপন্থীরা হিন্দুদের বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে ৭ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। এই ভিডিওটিও শেয়ার হতে দেখা যায় বিভিন্ন এক্স অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও ইউটিউবে (, , , , , )। 

ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, “আমি হুশিয়ার করে দিতে চাই, তাদের বিচারের জন্য যদি আবারও রাস্তায় নামা লাগে, আমরা আবারও রাস্তায় নামব। এখনও তারা ষড়যন্ত্র করছেন। কখনও হিন্দু নামে, কখনও সংখ্যালঘু নামে, কখনও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব বলে… চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের তারা কি বলেন! নেতা লিডার বলেন, তথাকথিত সাংবাদিক বলেন, তাদেরকে হুশিয়ার করে দিতে চাই। তোমরা তালবাহানা করবা না। লেজ গুটিয়ে দেশ থেকে ভাগো। অতিসত্ত্বর ভেগে যাও। সাবধান করে দিতেছি। সাবধান হয়ে যাও। এক সপ্তাহ তোমাদেরকে আল্টিমেটাম দিয়ে দিলাম। এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম। তারপরে তোমাদেরকে দেখে নিব।” সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো ভিডিওগুলোর দাবি ছিল, এই কথাগুলো বলা হয়েছে বাংলাদেশের হিন্দুদের উদ্দেশ্য করে। যদিও এই দাবিটি সঠিক নয়।

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রামে বিকিরণ নামের একটি সামাজিক সংগঠন আয়োজিত “জুলাই স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা” শীর্ষক অনুষ্ঠানে উক্ত বক্তব্যটি দিয়েছিলেন গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহত হওয়া শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ। ২৮ সেপ্টেম্বর ইউটিউবে আপলোড করা একটি ভিডিওতে তার পুরো বক্তব্যটি পাওয়া যায়। এমদাদ সেই এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম সংক্রান্ত কথাগুলো বলেছিলেন আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো মানুষদের উদ্দেশ্যে। 

ভিডিওটির ৪ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডে এমদাদ বলেন, “এখন পর্যন্ত স্বৈরাচারের দোসররা চট্টগ্রামের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেন ঘুরে বেড়াচ্ছে এর জবাব আমি চাই। তাদের এতো সাহস কিভাবে? তারা সশস্ত্রভাবে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নিউমার্কেটে চট্টগ্রামের ছাত্রজনতার উপর গুলি করেছে, তারা কেন এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়েচ্ছে?”

এই থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তিনি কথাগুলো বলেছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও তার সহযোগীদের উদ্দেশ্যে। প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটি এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির তালিকা অনুযায়ী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সারাদেশে ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত এবং ৩১ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। অর্থাৎ, এমদাদ কথাগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে বলেননি। তার বক্তব্যের শেষ অংশটুকুই শুধু প্রচার করা হয়েছে হিন্দুদের দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম দেওয়ার দাবি করে। 

ভিডিওগুলো প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমেও

শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই নয়, ভিডিও দুইটি প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমেও। এই দুই ভিডিওর উল্লেখ করে সিএনএন-নিউজ১৮ একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউটিউবে। যার শিরোনাম ছিল, “বাংলাদেশে কোন দুর্গা পূজা উদযাপন নয়: বাংলাদেশের হিন্দুদের ইসলামপন্থীদের হুশিয়ার”। এছাড়াও শুধু দ্বিতীয় ভিডিওটির প্রসঙ্গ ধরে সংবাদ প্রকাশ করেছে এশিয়ানেট নিউজ। যেখানে বলা হয়েছে, হিন্দুদের ৭ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। একই ভিডিও দ্য জয়পুর ডায়ালগ নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করে বাংলাদেশের সঙ্গে কাশ্মীরের পরিস্থিতির তুলনা টানা হয়েছে।

আরো কিছু লেখা