আহমেদ ইয়াসীর আবরার
ভারতে বিমানে সহযাত্রীকে চড় দেওয়া ব্যক্তি হিন্দু নন
আহমেদ ইয়াসীর আবরার
ভারতে ইন্ডিগো ফ্লাইটে একজন হিন্দু ব্যক্তি মুসলিম সহযাত্রীকে চড় মেরেছেন- এমন দাবিতে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সম্প্রতি মুসলিম উচ্ছেদ অভিযান বিতর্কের মাঝেই সাম্প্রদায়িক আঙ্গিকে ভিডিওটি ছড়াতে থাকে। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওতে চড় দেয়া ব্যক্তি হিন্দু ধর্মাবলম্বী নন।
“ছেলেটি একজন হাফেজে কুরআন। নাম হুসাইন আহমদ। বাড়ি লাটিমারা, আসাম, ভারত। টাইফয়েডে দু’চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছে। জমি বিক্রি করে মুম্বাই যায় উন্নত চিকিৎসার আশায়। অর্থের সঙ্কুলান হয়নি, তাই সাথে যেতে পারেনি পরিবারের কেউ। আসার পথে কলকাতা এয়ারপোর্টে এক নোংরা হি.ন্দু ঘটায় ঘটনাটি। হাতড়ে হাতড়ে নিজের সিট খুঁজছিল হাফেজ হুসাইন। শেষ দিকের একটি সিট ছিল ওর। হঠাৎ হুসাইনের হাত বসে থাকা সেই হি.ন্দু বিমানযাত্রী পীযূষ কর্মকারের চেহারায় লাগে। প্রচণ্ড রকম ক্ষেপে যায় পীযূষ। একপর্যায়ে উঠে কষে চড়ও মারে সে অসহায় হুসাইনের গালে! যেন একজন হি.ন্দু হিসেবে জন্মগতভাবেই ছিল তার কোনো মুসলমানের গায়ে হাত তোলার অধিকার।”- এমন দীর্ঘ একটি বিবরণ লিখে পোস্ট করা হয় খালিদ মোহাম্মদ নামের একটি প্রোফাইল থেকে। পোস্টের সাথে যুক্ত ৭ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটি বিমানের ভেতরে মাথায় টুপি দেয়া একজন ব্যক্তিকে হঠাৎ চড় মারলেন আরেকজন যাত্রী। ভিডিওটিতে কোনো শব্দ ছিল না। এখন পর্যন্ত ভিডিওটি শেয়ার হয়েছে অন্তত ১৮০০ বার, রিয়েকশন পেয়েছে প্রায় ১৩০০ এবং কমেন্ট হয়েছে ১২৭টি।
একই ক্যাপশনে এই ঘটনার ছবি যুক্ত করে পোস্ট ফেসবুক পেজ ‘ফ্রাইডে পোস্ট’। পেজটির পোস্টে যে ছবি যুক্ত করা হয় সেখানে লেখা, হুসাইন আহমদের অপরাধ সে একজন মুসলমান। ফ্রাইডে পোস্টের পোস্টটিও ৪০০-রও বেশি শেয়ার হয় এবং রিয়েকশন পায় ২ হাজারেরও বেশি।
একই ভিডিও সামাজিক মাধ্যম এক্সেও পোস্ট হতে দেখা গিয়েছে যেখানে দাবি করা হচ্ছে চড় দেয়া ব্যক্তিটি হিন্দু (১, ২)।
ভিডিওটির সূত্র যাচাইয়ে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে ভারতীয় তথ্যযাচাইকারী প্রতিষ্ঠান অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ম্যানেজার মোহাম্মাদ জুবায়েরের এক্স অ্যাকাউন্টের একটি পোস্ট। ১ আগস্টের এই পোস্টে তিনি বলেন, “ফ্লাইটে এক যাত্রী অস্বস্তি বোধ করছিলেন এবং নামতে চাচ্ছিলেন। এ সময় এক সহযাত্রী তাকে আক্রমণ করেন। উভয়েই একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের (মুসলিম) সদস্য। অভিযুক্ত যাত্রীকে বিশৃঙ্খল আচরণের কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।” তথ্যের সূত্র হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন জাগৃতি চন্দ্রাকে। জাগৃতি চন্দ্রা হলো ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুর এভিয়েশন সাংবাদিক। একই দিনে তিনিও তার এক্স অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দিয়ে নিশ্চিত করেন যে আক্রমণের শিকার এবং আক্রমণকারী ব্যক্তি উভয়ই একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তি।

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জাগৃতি চন্দ্রার সাথে। জাগৃতি চন্দ্রা ডিসমিসল্যাবকে জানান তার দেয়া তথ্য তিনি সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। তবে এরই মধ্যে বিধাননগর পুলিশ তাদের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ঘটনার দুই ব্যক্তির নাম জানিয়েছেন বলে ডিসমিসল্যাবের সাথে একটি পোস্ট শেয়ার করেন। ‘বিধাননগর পুলিশ’ এর এক্স পোস্টের থ্রেডে (১, ২) লেখা, “২০২৫ সালের ১ আগস্ট, মুম্বাই থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রাকালীন ইন্ডিগোর ৬ই-১৩৮ নম্বর ফ্লাইটে ভ্রমণরত দুই ভারতীয় পুরুষ যাত্রীর মধ্যে তীব্র বাকবিতণ্ডা হয়। এর একপর্যায়ে হাফিজুল রহমান অপর যাত্রী হুসাইন আহমেদ মজুমদারকে চড় মারেন। ইন্ডিগোর কেবিন ক্রু তাকে “অশান্ত যাত্রী” হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।” এই ঘটনায় ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকেও বক্তব্য প্রকাশ করা হয়।

১ আগস্টে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিতে আক্রমণের শিকার ব্যক্তির নাম হলো হুসাইন মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি প্রথমবারের মতো বিমানে যাত্রা করছিলেন এবং বিমানে তার প্যানিক অ্যাটাক হয়। তিনি বিমান থেকে নামিয়ে দেয়ার জন্য দাবি করলে ফ্লাইটে হট্টগোল তৈরি হয়। এই সময় হাফিজুল রহমান নামের একজন যাত্রী তাকে হঠাৎ চড় দিয়ে বসেন। দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আক্রমণের শিকার এবং আক্রমণকারী উভয় ব্যক্তিকেই বিমানবন্দর নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং পরবর্তীতে দুজনই জামিনে ছাড়া পান। এছাড়া, ইন্ডিগোর বক্তব্যের সূত্রে প্রতিবেদনে বলা হয় যে আক্রমণকারী ব্যক্তিকে ৩০ দিনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সকল ফ্লাইট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ফ্লাইটের ঘটনার পর হুসাইন আহমদ মজুমদারকে কলকাতা বিমানবন্দরে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে তার শিলচরগামী সংযোগ বিমানে ওঠার কথা থাকলেও পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি সেই বিমানে উঠেননি। এই দীর্ঘ সময়ে যোগাযোগ না হওয়ায় তার পরিবার তাকে নিখোঁজ হিসেবে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে। পুলিশ খোঁজ চালানোর পর আসামের বরপেটা রেলওয়ে স্টেশনে হুসাইন আহমদ মজুমদারের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভারতের একাধিক গণমাধ্যম (১, ২, ৩)।
অর্থাৎ, আক্রমণকারী ব্যক্তি হিন্দু এবং তার নাম পীযুষ কর্মকার, এই দাবিগুলো সত্য নয়।
প্রসঙ্গত, রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক সপ্তাহে আসামে কয়েক হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে হওয়া সবচেয়ে তীব্র এই উচ্ছেদ অভিযানের পাশাপাশি ভারতজুড়ে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দমন নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।