নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
অক্টোবর ২১, ২০২৫
১২:০৬:১২
বিএনপি-জামায়াতের সংঘর্ষের দাবিতে ছড়াচ্ছে ভিন্ন ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদের পুরোনো ছবি

বিএনপি-জামায়াতের সংঘর্ষের দাবিতে ছড়াচ্ছে ভিন্ন ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদের পুরোনো ছবি

অক্টোবর ২১, ২০২৫
১২:০৬:১২

নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

নোয়াখালী সদর উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষের ফলে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাবিতে বেশ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ডিসমিসল্যাব ফ্যাক্টচেক করে দেখেছে, মসজিদের ছবিগুলো নোয়াখালীর কোনো মসজিদ নয়। ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোর মধ্যে একটি আফগানিস্তানের একটি শিয়া মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনার। বাকি ছবিগুলো নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের। এই মসজিদগুলোর ছবির সঙ্গে নোয়াখালীর সংঘর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই। 

ফেসবুকের একটি ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে ছবিগুলো পোস্ট করে দাবি করা হয়, ছবিগুলো বিএনপি-জামায়াতের মধ্যকার সংঘর্ষের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদের। ক্যাপশনে বলা হয়, “এটা কোন ফিলিস্তিনের হামলা গাজার কোন মসজিদ না এটা নোয়াখালী সদর উপজেলা, বিএনপির জামায়াতে হামলার শিকার এই মসজিদ। তোদের অধঃপতন অনিবার্য”। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পোস্টটি ৩ হাজার ৩০০ বার শেয়ার হয়েছে।

একই দাবি করে একাধিক ব্যক্তিগত প্রোফাইল (, , , , , , , , ) থেকে ছবিগুলো পোস্ট হতে দেখা যায়। এক্স-এও একই দাবিতে ছবিগুলো পোস্ট হতে দেখা যায়। 

একটি ছবিতে দেখা যায়, সাদা রঙ-এর দেয়াল এবং সাদা টাইলসের পিলার সংবলিত একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবন। এর মেঝেতে অসংখ্য কাঁচের টুকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভবনে কিছু ব্যক্তিকেও দেখা যায়। ডিসমিসল্যাব ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখলে দ্যা ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন সামনে আসে। ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে ব্যবহৃত ছবিটির সাথে ছড়িয়ে পড়া পোস্টটির একটি ছবি হুবহু সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জের বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ২৪ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও বহু মানুষ দগ্ধ হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগের শরীরের ৭০ শতাংশের বেশি অংশ পুড়ে গেছে।”

এই ঘটনা নিয়ে সে সময় একাধিক (, , , ) প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ছবিটি দেখা যায়।

আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, একটি মসজিদের ভিতরের দৃশ্য। মেঝেতে পোড়া কার্পেট দেখা যায় এবং মসজিদে ৪ জন ব্যক্তি দাঁড়ানো। একজন ব্যক্তিকে দেখা যায় সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবী এবং টুপি পরিহিত অবস্থায়। তার গায়ে খয়েরি একটি কটিও দেখা যায়। তার পিছনে নীল পায়জামা পাঞ্জাবী পরিহিত আরেকজন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করা যায়। ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ভয়েজ অফ আমেরিকা পশতুনের একটি প্রতিবেদন সামনে আসে। 

২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “কাবুলের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা রয়টার্স সংবাদ সংস্থাকে শুক্রবার, ২২ অক্টোবর (৩০ মিজান) জানিয়েছেন যে তারা আশা করেন তালিবান শিয়া মসজিদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বজায় রাখবে। কাবুলের বাসিন্দারা এমন এক পরিস্থিতিতে এই আশা প্রকাশ করেছেন, যখন গত দুই শুক্রবার কুন্দুজ ও কান্দাহারের শিয়া মসজিদগুলোতে আইএস গোষ্ঠীর হামলায় একশরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।” এই ঘটনার একাধিক (, , , ) প্রতিবেদন পাওয়া যায়, যেখানে ছড়িয়ে পড়া ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে।

তৃতীয় ছবিটিতে দেখা যায়, মসজিদের ভিতরে একটি কাঠের মিম্বার এবং তার সামনে একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে আছেন। মিম্বারটির পিছনে সবুজ রঙ এর টাইলস দেখা যায়। ছবিটি যাচাই করার জন্য ডিসমিসল্যাব রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ঢাকা পোস্টের ২০২১ সালের ১ জানুয়ারির একটি প্রতিবেদন সামনে আসে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, “নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণ : ২৯ জনের বিরুদ্ধে সিআইডির চার্জশিট”।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের মামলায় মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ঘটনার প্রায় তিন মাস পর বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামানের কাছে এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক বাবুল হোসেন”। এছাড়াও একাধিক (, , , ) প্রতিবেদন ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে যেখানে ছড়িয়ে পড়া ছবিটি রয়েছে।  

শেষ ছবিটিতে দেখা যায়, মেঝেতে বিভিন্ন জিনিস এবং কাঁচের টুকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখলে দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়, যেখানে এই ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণটি যেন ঘটার অপেক্ষায়ই ছিল, কারণ প্রাণঘাতী ওই বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান সেখানে উপস্থিত ছিল। মসজিদের নিচে ক্ষতিগ্রস্ত গ্যাস লাইন এবং পাশের অবৈধ সংযোগ থেকে গ্যাস জমে ছিল ভেতরে। সেই সঙ্গে মসজিদের অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে উৎপন্ন একটিমাত্র স্পার্কেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যাতে ৩১ জনের মৃত্যু হয় এবং অনেকেই গুরুতর আহত হন।” এছাড়াও একাধিক (, , ) প্রতিবেদন ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে যেখানে ছড়িয়ে পড়া ছবিটি রয়েছে। 

অর্থাৎ, ছড়িয়ে পড়া চারটি ছবির মধ্যে তিনটি ছবিই নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদে গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণের ঘটনার ছবি। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ৩৭ জন মুসল্লি ও একজন পথচারী অগ্নিদগ্ধ হন। তার মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। 

প্রসঙ্গত, গত ১৯ অক্টোবর নোয়াখালী সদর উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর ১৯ তারিখের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “নোয়াখালী সদর উপজেলায় ইসলামী ছাত্রশিবির ও যুবদলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। আজ রোববার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উপজেলার নেয়াজপুর ইউনিয়নের কাশেমবাজারে জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। হামলায় মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে এটা নিয়ে এলাকায় দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।”

অর্থাৎ, ১৯ আগস্ট নোয়াখালীতে হওয়া বিএনপি-জামায়াতের মধ্যকার সংঘর্ষের সাথে এই ছবিগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।

আরো কিছু লেখা