নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

সুদেষ্ণা মহাজন অর্পা

ইন্টার্ন, ডিসমিসল্যাব
This article is more than 2 months old
আওয়ামী লীগের ডাকা লকডাউনে সেনাবাহিনী কার্যকর ভূমিকা রাখবে না বলে ছড়ানো পুরোনো ভিডিও ফ্যাক্টচেক

লকডাউনে সেনাবাহিনী কার্যকর ভূমিকা রাখবে না দাবিতে ছড়াচ্ছে পুরোনো অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও

সুদেষ্ণা মহাজন অর্পা

ইন্টার্ন, ডিসমিসল্যাব

নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ডাকা ১৩ নভেম্বরের “লকডাউন” কর্মসূচিতে সেনাবাহিনী কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে দাবিতে অন্তত তিনটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। তবে ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকে দেখা যায়, ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোর মধ্যে একটি ভিডিও ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট রাজশাহী সেনানিবাসে সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া সেনাপ্রধানের বক্তব্যের একটি অংশবিশেষ। দ্বিতীয়টি গাজীপুরের শ্রীপুরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ের। এবং তৃতীয়টি গুম সংক্রান্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জনকে হেফাজতে নেওয়া প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর এক মাস পুরোনো প্রেস ব্রিফিংয়ের।

দাবি ১

ফেসবুকের একটি ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে ১২ নভেম্বর ১৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। বিবরণে লেখা, “১৩ তারিখ লকডাউন ঘিরে সেনাবাহিনী কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই সেনাবাহিনী বিভিন্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আছে, আপনারা নির্ভয়ে প্রস্তুতি গ্রহন করুন। ১৩ তারিখ ঢাকার রাজপথ আমাদের দখলে থাকবে ইনশাআল্লাহ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। আগেই বলেছিলাম ১৩ তারিখ ঘিরে সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। সেনাবাহিনী আওয়ামীলীগ এর উপর আর কোনো অত্যাচার চালাবে না। কালকের মাঝে আমাদের দেশ প্রেমিক পুলিশ ভাইরাও নিরব ভূমিকা পালন করবে। আপনারা নির্ভয়ে রাস্তায় নামুন। মনে রাখবেন এটা আমাদের বাঁচার লড়াই। আমাদের মুক্তির লড়াই। স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই। ১৩ তারিখ লকডাউন সফল হোক।” (লেখা অপরিবর্তিত)

এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ভিডিওটি ২৫ হাজারের বেশিবার দেখা হয়েছে এবং প্রায় দুই শ বার শেয়ার করা হয়েছে।

ফেসবুকের বেশকিছু ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকেও (, , , , ) একই দাবিতে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়। সেখানে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে বিচারবহির্ভূত হামলা প্রসঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে পোস্টের বিবরণে থাকা বক্তব্যের কোনো মিল পাওয়া যায় না।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর সত্যতা খুঁজতে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে সময় টিভির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রচারিত ভিডিও খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। গত বছরের ১৩ আগস্টে প্রকাশিত সেই ভিডিওটির বিবরণে লেখা, “সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনে সহযোগিতা করবে সেনাবাহিনী: সেনাপ্রধান।” দেখা যায়, ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের ভিডিওর ৩ মিনিট ৭ সেকেন্ড থেকে ৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ড অংশের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির হুবহু মিল রয়েছে। এছাড়াও এই বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য হিসেবে ইউটিউবে একাধিক (, , ) ভিডিও পাওয়া যায়।

অধিকতর যাচাইয়ে ঘটনার প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কিওয়ার্ডও সার্চ করে দেখে ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, একই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক (, , , ) প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট প্রকাশিত প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “তাঁদের জীবনের যে হুমকি আছে, সেটার জন্য আমরা আশ্রয় দিয়েছি: সেনাপ্রধান।” প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজশাহী সেনানিবাসের এক ব্রিফিংয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সেনা হেফাজতে নেওয়া সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান এসব কথা বলেন।

অর্থাৎ, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের ভিডিওটি গত বছরের আগস্ট মাসে ভিন্ন প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্যের একটি খণ্ডিত অংশ। এর সঙ্গে ২০২৫ সালের ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ঢাকা লকডাউন কর্মসূচির কোনো সম্পর্ক নেই। 

দাবি ২

ফেসবুকের একটি ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে গত ১০ নভেম্বর ১৩ সেকেন্ডের এই ভিডিও পোস্ট করা হয়। বিবরণে লেখা, “১৩ তারিখ ঢাকা লকডাউনে সেনাবাহিনী কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের মিছিলে বাঁধা দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আছে, এবার এমন কিছু করলে তাদের উপর সামরিক নিষেধাজ্ঞা আসবে। তাই আপনারা নির্ভয়ে প্রস্তুতি গ্রহন করুন। ১৩ তারিখ ঢাকার রাজপথ আমাদের দখলে থাকবে ইনশাআল্লাহ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।” (লেখা অপরিবর্তিত)

এ পর্যন্ত ভিডিওটি প্রায় ৭০ হাজারের বেশিবার দেখা হয়েছে এবং ২৪১ বার শেয়ার করা হয়েছে।

ফেসবুকের বেশকিছু ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকেও (, , , , ) একই দাবিতে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়। ভিডিওতে “লুৎফর” নামফলক পরিহিত এক সেনা কর্মকর্তাকে ন্যায় এবং দেশের পক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাজ করা প্রসঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এখানেও কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে পোস্টের বিবরণে লেখা দাবির কোনো মিল পাওয়া যায় না।

ভিডিওর কিফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে সংবাদমাধ্যম ঢাকা প্রতিদিনের ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও পাওয়া যায়। চলতি বছরের ৭ নভেম্বরে প্রকাশিত ভিডিওর বিবরণে লেখা, “গাজীপুরের শ্রীপুরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিং।” ৪ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের ভিডিওর ১২ সেকেন্ড থেকে ২২ সেকেন্ড অংশের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও অনলাইনে একই বিষয়ে একাধিক (, , ) ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

এ ঘটনা নিয়ে অধিকতর যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করে দেখে ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, একই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক (, , ) প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গত ৭ নভেম্বর যুগান্তরের প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “এনামুলের গ্রেফতার ঘিরে ‘অপপ্রচার’ চালানোর অভিযোগ সেনাবাহিনীর।” প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুরে ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ এনামুল হক মোল্লাকে গ্রেফতারের ঘটনাকে ঘিরে ‘অপপ্রচার’ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে সেনাবাহিনী। এসব অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানিয়ে সেনাবাহিনীর গাজীপুর ক্যাম্পে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনী থেকে জানানো হয়, সেনাবাহিনী সবসময় ন্যায়ের এবং দেশের পক্ষে। ৭ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেনা ক্যাম্পে আয়োজিত ওই প্রেস ব্রিফিংয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. লুৎফর রহমান এসব কথা বলেন।

অর্থাৎ, সেনা কর্মকর্তার বক্তব্যের ভিডিওটি ভিন্ন ঘটনায় দেওয়া বক্তব্যের একটি অংশ। এর সঙ্গে ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ঢাকা লকডাউনের কোনো সম্পর্ক নেই।

দাবি ৩

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একটি পেজ থেকে গত ১১ নভেম্বর রাতে ১৫ সেকেন্ডের ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। আগের দুই ভুয়া পোস্টের বিবরণের সঙ্গে মিল রেখে একই দাবিতে লেখা, “১৩ তারিখ ঢাকা লকডাউনে সেনাবাহিনী কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে।এমনিতেই সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের মিছিলে বাঁধা দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আছে, এবার এমন কিছু করলে তাদের উপর সামরিক নিষেধাজ্ঞা আসবে। তাই আপনারা নির্ভয়ে প্রস্তুতি গ্রহন করুন। ১৩ তারিখ ঢাকার রাজপথ আমাদের দখলে থাকবে ইনশাআল্লাহ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু” (লেখা অপরিবর্তিত)

ভিডিওটি এখন পর্যন্ত প্রায় সাত লাখবার দেখা হয়েছে এবং দেড় হাজারের বেশি শেয়ার করা হয়েছে।

ফেসবুকের আরও কিছু ব্যক্তিগত পেজ-প্রোফাইল থেকে (, , , , ) একই দাবিতে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, “জামান” নামফলক পরিহিত একজন সেনা কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, “বাংলাদেশ আর্মি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চায় তারা সবসময় জাস্টিসের পক্ষে থাকবে। ইনসাফের সাথে কোনো সমঝোতা হবে না। যেটা জাস্টিস হবে, সেটার পক্ষে সর্বদা দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।” এই ভিডিওর ক্ষেত্রে কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে পোস্টের বিবরণে লেখা দাবির কোনো মিল পাওয়া যায় না।

ভিডিওর সত্যতা যাচাইয়ে বিভিন্ন কিফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে সংবাদমাধ্যম একুশে টেলিভিশনের ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত সেনাবাহিনীর সংবাদ সম্মেলনের একটি ভিডিও পাওয়া যায়। চলতি বছরের ১১ অক্টোবর প্রকাশিত সেই ভিডিওর বিবরণে লেখা, “সেই ২৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জনকে হেফাজতে নিয়েছে সেনাবাহিনী |” ৪৪ মিনিট ৮ সেকেন্ডের সেই ভিডিও প্রতিবেদনের ২৭ মিনিট ২১ সেকেন্ড থেকে ২৭ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড অংশের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একই বিষয়ে ইউটিউবে একাধিক (, , ) ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

এ ঘটনা নিয়ে অধিকতর যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করে দেখে ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, একই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক (,,,) প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

আজকের পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ২৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে চাকরিরত ১৫ জন সেনা হেফাজতে রয়েছেন। অভিযুক্ত সদস্যদের বিষয়ে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে সেনাবাহিনী এমন সব বিস্তারিত তথ্য চলতি বছরে ১১ অক্টোবর একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান।

অর্থাৎ, সংবাদ সম্মেলনে মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামানের কথার ২৪ সেকেন্ডের একটি অংশ ভিডিও সম্পাদনা করে সেটি ১৩ তারিখ ঢাকা লকডাউনে সেনাবাহিনী কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে না এমন ভুয়া দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ডাকা “ঢাকা লকডাউন” কর্মসূচির সময় সেনাবাহিনী মাঠে মোতায়েন থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

আরো কিছু লেখা