নোশিন তাবাসসুম

শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসীদের মরদেহ পুড়ে যাওয়া দাবিতে ছড়িয়েছে ভিন্ন ঘটনার ভিডিও
নোশিন তাবাসসুম
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রবাসীদের মরদেহ পুড়ে যাওয়ার দাবি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ফ্যাক্টচেক করে দেখা গেছে, ছড়িয়ে পড়া পোস্টের এই দাবিগুলো ভুয়া এবং ভিডিওতে দেখানো দৃশ্যগুলো ঢাকার নয় বরং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা আট ওমান প্রবাসীর মরদেহ হস্তান্তরের।
দাবি ১
রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ফেরত আনা একাধিক প্রবাসীদের মরদেহ সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ৫ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ভবন থেকে একে একে ৩টি অ্যাম্বুলেন্স বের হচ্ছে।

পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, “রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রবাসীদের ফেরত আনা একাধিক মরদেহ সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি ইউনিট টানা কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও তখন পর্যন্ত মূল্যবান কার্গোসহ প্রবাসীদের কফিনে রাখা লাশগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।”
ঘটনাটি যাচাইয়ের জন্য ভিডিওটির কি-ফ্রেম ধরে সার্চ করলে, ফেসবুকে ৫৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যার ৮ সেকেন্ড থেকে ১২ সেকেন্ড ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সন্দ্বীপ টিভির ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি গত ১৮ অক্টোবর পোস্ট করা হয়েছে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, “ওমানে নিহত ৭ টি নিথর দেহ বাক্সবন্দি হয়ে যাচ্ছে কুমিরা ঘাটে।”

অধিকতর যাচাই এর জন্য ওমান এবং প্রবাসী সূত্র ধরে কিওয়ার্ড সার্চে একাধিক গণমাধ্যমে (১, ২, ৩, ৪) গত ৮ অক্টোবর ওমানের দুখুম প্রদেশের সিদরা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ জন প্রবাসী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তাদের মরদেহ গত ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়।
এই ঘটনার একাধিক (১, ২, ৩, ৪) প্রতিবেদন পাওয়া যায়। দৈনিক আজাদী এর ১৯ অক্টোবরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “গত ৮ অক্টোবর ওমানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের আটজন প্রবাসী নিহত হয়। এরমধ্যে সাতজনই চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বাসিন্দা। অন্যজনের বাড়ি রাউজান উপজেলায়। ১০ দিন পর শনিবার এল প্রবাসীদের লাশ। রাত ৯টা ৫ মিনিটে একে একে বিমানবন্দরের কার্গো গেইট দিয়ে বের হয়ে আসে ৮টি লাশবাহী কফিন। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাশবাহী সাতটি অ্যাম্বুলেন্স কুমিরা ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।”

এছাড়া ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখতে পাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে “সামিয়া ফ্রিজার সার্ভিস” এর নাম্বারে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। এই লাশ বহনকারী সংস্থা ডিসমিসল্যাবকে নিশ্চিত করে, মরদেহগুলো প্রবাসীদের পরিবারের কাছে হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দর থেকে যথাযথভাবে সন্দ্বীপে পৌঁছানো হয়েছে।
দাবি ২
বিদেশ থেকে আসা মরদেহ বিমানবন্দরে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে শুরুতে দেখা যায়, কয়েকটি কফিনের পিছনে বেশ কিছু ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। এরপরে কফিনগুলোকে নামানো হচ্ছে এমন দৃশ্য দেখা যায়। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, “৬/৭ দিন পরে লা’শ দেশে আসলো!বাড়িতে পৌঁছার আগেই বিমানবন্দরে পু’ড়ে ছা’ই,আহা জীবন!”। ভিডিওর ভেতরে লেখা, “প্রবাসীদের লাশ বিমানবন্দরে আগুনে পুড়ে ছাই!”।

ফেসবুকের একাধিক প্রোফাইল (১, ২, ৩) এবং পেজ (১, ২, ৩) থেকে একই দাবিতে ভিডিওটি শেয়ার করতে দেখা যায়।
যাচাইয়ের জন্য ভিডিওটির কি-ফ্রেম ধরে সার্চ করলে, ফেসবুকে ১৫ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যা ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। নিউজ ২৪ এর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি গত ১৮ অক্টোবর পোস্ট করা হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির সঙ্গে নিউজ ২৪ এর ভিডিওটির ৯ মিনিট ১৬ সেকেন্ড থেকে ১০ মিনিট ০৬ সেকেন্ড দৃশ্যে মিল রয়েছে। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা, “সরাসরি>>>চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছেছে ওমানে সড়ক দু/র্ঘটনায় নি/হত ৭ প্রবাসীর ম/র/দেহ”।

এছাড়া, ভিডিওটির কি-ফ্রেম ধরে সার্চ করলে, একাধিক (১, ২, ৩, ৪) সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এই সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে ব্যবহৃত ছবির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির একাধিক দৃশ্যে মিল রয়েছে। আজকের পত্রিকার ১৯ অক্টোবরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আট বাংলাদেশির মরদেহ চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। শনিবার রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট ওমানের মাস্কাট থেকে কফিনবন্দী মরদেহগুলো নিয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে কর্তৃপক্ষ রাত সোয়া ৯টার পর মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. ইব্রাহীম খলিল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।”

অর্থাৎ, ভিডিওটি চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঘটনা। এবং সেখানে গত ১৮ অক্টোবরে আগুন লাগার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
প্রসঙ্গত, গত ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টার দিকে ওমানের দুখুম সিদরা এলাকায় দুর্ঘটনায় সন্দ্বীপ উপজেলার সাত প্রবাসীসহ আটজন নিহত হন। এর মধ্যে সারিকাইত ইউনিয়নের পাঁচ, মাইটভাঙার এক ও রহমতপুরে ইউনিয়নের একজন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন সারিকাইতের আমিন মাঝি, মো. আরজু, মো. রকি, সাহাব উদ্দিন ও মো. বাবলু এবং মাইটভাঙার মো. জুয়েল ও রহমতপুরের মো. রনি। অপরজন রাউজানের চিকদার ইউনিয়নের ইউসুফের ছেলে বলে জানা গেছে। সিদরা থেকে সাগরমুখী একটি মাছ পরিবহনের বড় গাড়ি বেপরোয়া গতিতে ধাক্কা দিলে তাদের গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। গত ১৮ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে গতকাল শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর চালু হয়।