ফাতেমা তাবাসুম
ফেসবুকের বিজ্ঞাপনে ইন্টারনেট অফারের নামে সাবস্ক্রিপশন ফাঁদ
ফাতেমা তাবাসুম
সম্প্রতি ফেসবুকের বেশ কয়েকটি পেজ থেকে নির্দিষ্ট সিম ব্যবহাকারীদের জন্য একটি বিশেষ মোবাইল ইন্টারনেটের অফার জানিয়ে পোস্ট শেয়ার করতে দেখা গেছে। পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, ব্যবহারকারীরা কোনোরকম খরচ ছাড়াই এই অফারটি নিতে পারবেন। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত অন্তত ১০টি ফেসবুক পেজ থেকে এ ধরনের পোস্ট ছড়ানো হয়েছে। এছাড়া কিছু পেজ থেকে বিজ্ঞাপনও চালানো হয়েছে। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি সত্যিকারের অফারের পোস্ট নয় বরং এসব পোস্টের মূল উদ্দেশ্য, ব্যবহারকারীর ওটিপি সংগ্রহ করে ভিন্ন একটি ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসে সাবস্ক্রাইব করানো এবং আর্থিক ক্ষতিসাধন করা।
মোবাইল ইন্টারনেটের অফার সংক্রান্ত বেশিরভাগ ফেসবুক পোস্টের বিবরণের শুরুতে লেখা, “এক্সক্লুসিভ লিমিটেড-টাইম মেগা ইন্টারনেট অফার। ২৫ জিবি প্রিমিয়াম ইন্টারনেট – সম্পূর্ণ ফ্রি!” পোস্টগুলোতে (১, ২, ৩) অফার প্রযোজ্য সিমের নাম হিসেবে বলা হয়– গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও এয়ারটেল। পোস্টগুলোর বিবরণে ফ্রি ডেটা পেতে কী করতে হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে গিয়ে বলা হয়েছে, সেখানে যুক্ত লিঙ্কে ক্লিক করতে পোস্টের একদম নিচে “লার্ন মোর” বাটনে ক্লিক করতে। এরপর কিছু সহজ প্রশ্নের উত্তর দিলেই ব্যবহারকারীদের নিজ নিজ নাম্বারে ফ্রি ডাটা সচল হবে।

পোস্টগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিটি ক্যাপশনের ভাষা প্রায় একই। অফার সংক্রান্ত এমন আরও পোস্ট আছে কি না তা যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে দেখা যায়, ফ্রি ডেটার দুনিয়া 2025, বাংলা ফ্রি ইন্টারনেট, নেট অফার ঘর-সহ অন্তত ১১টি ফেসবুক পেজ থেকে গত এপ্রিল মাস থেকে এই একই ধরনের অফারের পোস্ট করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি কার্ডেই অফারটি প্রচারের জন্য অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী ও তানজিন তিশার একাধিক ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
এছাড়া মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে “২৫ জিবি প্রিমিয়াম ইন্টারনেট — একদম ফ্রি!” কি-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে দেখা গেছে, শুধুমাত্র ১০ জুলাইয়েই এ ধরনের ১৪টিরও বেশি বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে। পরের দিন, ১১ জুলাই আরও দুইটি বিজ্ঞাপন সক্রিয় ছিল।

ফেসবুকের যেসব পোস্টে সরাসরি লিঙ্ক শেয়ার করা হয়েছে, সেই পোস্টের ‘লার্ন মোর’ অপশনে ক্লিক করলে ব্যবহারকারীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভুয়া ওয়েবসাইটে, যেমন মাই অফার বিডি ডট শপ বা ফ্রি ডাটা হাব ডট শপ-এর মতো নামের কিছু প্রক্সি সাইটে। এসব সাইটে প্রথমেই দেখা যায় একটি বার্তা: “অফারটি পেতে অবশ্যই আপনার মোবাইল নম্বর সাবমিট করে মোবাইলে যে পিনকোড যাবে সেটি দিয়ে ওটিপি ভেরিফিকেশন করুন।” এই নির্দেশনার নিচেই ২ মিনিটের একটি নির্ধারিত সময়সীমা চলতে থাকে। এরপরেই দেখা যায় “বাংলালিংক ২৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট”, “গ্রামীনফোন ২৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট”, “রবি ২৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট”, “এয়ারটেল ২৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট”, এছাড়াও “সকল মিনিট অফার”, “বাংলালিংক ২০০ মিনিট ফ্রি”, “গ্রামীণফোন ২০০ মিনিট ফ্রি” – এমন অফারের তালিকা।

এই অফারগুলোর যেকোনো একটিতে ক্লিক করলে ব্যবহারকারীকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ এক ধরনের প্রক্সি ওয়েবসাইটে; যেখানে প্রথমেই চাওয়া হয় ফোন নম্বর। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ফোন নম্বর দেওয়ার পর তৎক্ষণাৎ একটি বার্তা আসে, যেখানে লেখা: “পিন কোড ৯৫৭৮ ব্যবহার করে ক্লাউডসেভেন ফানবক্স ডেইলি সার্ভিসটি অ্যাক্টিভেট করুন।” এবারে এই পিন বা ওটিপি প্রবেশ করানোর সঙ্গে সঙ্গে ফোন নম্বরটি যুক্ত হয়ে যেতে পারে কোনো থার্ড পার্টি ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসে (ভিএএস)। এমনি একটি সার্ভিসে দেখা যায়, সেখানে লেখা সার্ভিসটি চালু করলে এর খরচ পড়বে দিনে ৩.০৩ টাকা এবং সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকবে। ফলে ব্যবহারকারীর অজান্তেই প্রতিদিন মোবাইল ব্যালেন্স থেকে টাকা কাটা শুরু হতে পারে।
এছাড়াও, টেলিকম সার্ভিস এয়ারটেল, বাংলালিংক, গ্রামীনফোন ও রবির মূল ওয়েবসাইটে এই ধরনের কোনো প্রচারণা দেখা যায়নি। বাংলালিংক ও গ্রামীণফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেসবুকে চলমান এই অফারের বিজ্ঞাপন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা জানায়, এই ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন তারা প্রচার করেননি। এই বিজ্ঞাপনে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা-ও সঠিক নয়। তারা নিশ্চিত করেন, তাদের সব ধরনের অফার শুধুমাত্র তাদের নির্ধারিত মোবাইল অ্যাপ এবং অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেই প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে, নির্ধারিত অ্যাপ, ওয়েবসাইট কিংবা ভেরিফায়েড পেজে কোনো অফার উল্লেখ না থাকলে, অন্য কোনো উৎস থেকে প্রচারিত এমন বিজ্ঞাপনের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
পোস্টগুলো যে ১০টি পেজ থেকে করা হয়েছে তার মধ্যে তিনটি পেজের অ্যাডমিন লোকেশন বাংলাদেশে দেখা গেলেও, বাকিগুলোর অ্যাডমিন লোকেশন উল্লেখ করা নেই। এছাড়া সবগুলো পেজই খোলা হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে।
প্রসঙ্গত, ফেসবুকে টেলিকম কোম্পানি বা অন্য জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নামে অফারের প্রচারণার মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও নারী দিবস উপলক্ষে আড়ং ও বিকাশের নামে ছড়ানো ভুয়া অফারের পোস্টসহ একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডিসমিসল্যাব।