ফাতেমা তাবাসুম

কৃত্রিম জনতা, ভুল পতাকা: সামাজিক মাধ্যমে মার্চ ফর গাজার এআই ছবি ভাইরাল
ফাতেমা তাবাসুম
সামাজিক মাধ্যমে গতকাল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত মার্চ ফর গাজার দুটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। ছবি দুটিতে দেখা যায়, একটি প্রশস্ত সড়কের ওপর বিপুল সংখ্যক মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং তাদের মাঝে একটি বিশাল পতাকা। এই পতাকার রঙ ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—কালো, সাদা, সবুজ এবং লাল। জনসমাগমের ভেতর দিয়ে সোজা অবস্থায় টানা পতাকাটি ছবির কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে স্থান পেয়েছে।
দৃশ্যটি জনসমাগম ও প্রতীকী ব্যবহারের বিচারে আকর্ষণীয়, তবে যাচাইয়ের ফলাফল বলছে, এটি আসল নয়, এবং প্রায় নিশ্চিতভাবে এআই দিয়ে তৈরি।
ফেসবুক (১, ২, ৩, ৪), এক্স, ইনস্টাগ্রাম (১, ২) , থ্রেডস (১, ২) এবং একাধিক ইউটিউব চ্যানেলে (১, ২, ৩) ছবিগুলো শেয়ার করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের আসল পতাকা তিন রঙের অনুভূমিক সারি এবং এক পাশে, মাঝ বরাবর একটি ত্রিভুজ নিয়ে গঠিত। উপরে কালো, মাঝখানে সাদা, নিচে সবুজ এবং বাঁ দিকে সেই লাল ত্রিভুজ।

ছবি দুটির পতাকা এই আদর্শ কাঠামোর কাছাকাছি হলেও তাদের মধ্যে কিছু গঠনগত অসঙ্গতি দেখা যায়। বিশেষ করে লাল ত্রিভুজটির আকার ও অবস্থান প্রকৃত পতাকার ত্রিভুজের সঙ্গে মেলে না।
ভাইরাল হওয়া প্রথম ছবিতে লাল রঙের একটি অতিরিক্ত সারিও রয়েছে, ফলে রঙের চারটি সারি তৈরি হয়েছে। মূল নকশা অনুযায়ী কালো রঙ ওপরে থাকার কথা, কিন্তু এই ছবিতে সেটি নিচের সারিতে। একই সঙ্গে, সারিগুলোর অনুপাত, রঙের প্রান্ত এবং কাপড়ের গুণাবলি—যেমন ভাঁজ, বাতাসে দুলে ওঠা কিংবা আলোর প্রতিফলন—দৃষ্টিগোচর নয়।

দ্বিতীয় ছবিতে এআইয়ের সংকেত আরও স্পষ্ট। যেমন, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মতো দেখতে পতাকাগুলো দুই পাশে অবাস্তব রকমের নিখুঁতভাবে ও সমান দূরত্বে সাজানো, যা সাধারণত বাস্তব মিছিলে দেখা যায় না।
এই ছবির বড় পতাকায় আবার দুদিকেই লাল রঙের ত্রিভুজ রয়েছে। পুরো পতাকা সোজা, তবে সামনের ত্রিভুজটি বাঁকা। এর সম্মুখ কোণটি মূল নকশার মতো মাঝখানে না থেকে, একপাশের কালো রঙের সঙ্গে মিশেছে।

দুটো ছবির ক্ষেত্রেই বড় পতাকায় অসঙ্গতি আলাদা করে চোখে পড়ে। দীর্ঘ একটি পতাকা নিখুঁতভাবে টানটান অবস্থায় রয়েছে, তাতে কোথাও কোনো ভাঁজ বা মোচড়ের লক্ষণ নেই। ধারে বা মাঝখানে কোথাও ওঠানামা, ওজনের ভারসাম্য, বা মানুষের হাতের বিভিন্ন অবস্থানও দেখা যাচ্ছে না। যদিও বাস্তবে এত বিশাল পতাকা জমিতে বা জনতার মাথার উপর পুরোপুরি টানটান ও সোজা রাখা কঠিন।
প্রথম ছবিতে বড় পতাকার দুই পাশের ছোট ছোট পতাকাগুলো সমমিতিক সারিতে সাজানো; একই দিকে একই ভাবে উড়ছে। এধরনের নিখুঁত পুনরাবৃত্তিক প্যাটার্ন এআই ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
দ্বিতীয় ছবিতে, মানুষের হাতে দেখা যাওয়া ছোট বাংলাদেশের পতাকাগুলোরও একই দশা। কারও কারও হাতের পতাকাগুলো অস্বাভাবিক বাঁকা বা শূন্যে ভাসমান মনে হয়—যা বাস্তব মিছিল বা সমাবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ফেসবুকে এই সমাবশ ও সেখানে মানুষের পতাকা নিয়ে হেটে যাওয়ার অনেক ছবি (১, ২, ৩) ও ভিডিও মেলে। একটি ছবিতে দেখা যায়, অনেকে একটি দীর্ঘ ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে ধরে মিছিল নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে মানুষের পোশাক, মুখাবয়ব, পতাকা ধরার ধরন, রাস্তায় থাকা যানবাহন এবং আশপাশের পরিবেশ—সবকিছু স্বাভাবিক দৃশ্যের মতোই। এই ছবি তোলা হয়েছে দিনে, এবং রাস্তাটির পাশে গাছপালা ও রেলিংও দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি রাখলেই, বাস্তব ও এআই ছবির পার্থক্য ধরা যায়।

মানুষের সারিবিন্যাসও ভাইরাল ছবি দুটির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পুরো দৃশ্যজুড়ে হাজার হাজার মানুষ প্রায় অভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার পোশাক, রঙের সামঞ্জস্যতা, এবং পতাকা ধারণের ধরণ এতটাই অভিন্ন যে তা প্রায় গাণিতিকভাবে বিন্যস্ত বলে মনে হয়।
দ্বিতীয়টিতে সবার পোশাক সাদা অথবা সবুজ রঙের এবং সবাই টুপি পরা। ছবিটি জুম বা বড় করে দেখলে অনেক মানুষের মুখ অস্পষ্ট, বিকৃত কিংবা প্রায় একই রকম দেখায়।
দুটি ছবিতেই মানবিক বিচ্যুতি—যেমন কেউ একটু এদিক-ওদিক তাকাবে, কারও পতাকা কিছুটা বাঁকা হবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে বা সামনে এগিয়ে আসবে—এই ধরনের বৈচিত্র্য অনুপস্থিত। দুই ছবিতেই অত্যন্ত সুষম ও ধারাবাহিক প্যাটার্নের ছাপ রয়েছে, যা স্বাভাবিক জনসমাবেশে বিরল।
দৈনিক সমকালের তোলা, সমাবেশের বাস্তব ছবির সঙ্গে এআই-সংকেতযুক্ত ছবির অনেক পার্থক্য মেলে। আসল ছবিতে দৃশ্যমান বড় বড় গাছ, খোলা মাঠ এবং মাঝখানে একটি জলাশয়ের পাশে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়। তাতে মানুষের অবস্থানও স্বাভাবিক: পোশাকে বৈচিত্র্য রয়েছে, পতাকা ধরার ধরনে বিভিন্নতা আছে, এবং পুরো পরিবেশে আলো ও ছায়ার উপস্থিতি বাস্তবতার প্রমাণ দিচ্ছে।

অন্যদিকে, ভাইরাল ছবি দুটিতে সুষম, ত্রুটিহীন এবং সম্পূর্ণ সোজা পতাকা ও সারিবদ্ধ মানুষ দেখা যায়। সেখানে বাস্তব পরিবেশের মতো বৈচিত্র্য ও বিশৃঙ্খলা নেই।
ভাইরাল ছবিতে সমাবেশ দেখানো হচ্ছে একটি সড়কে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নয়। সড়কটি এতটাই প্রশস্ত যে একেকটি লেনের স্বাভাবিক পাশ অনুপাতে সেখানে গুনে অন্তত ১৪টি লেন পাওয়া যায়। এলাকাটি যাদের কাছে অচেনা, তারা গুগল ম্যাপের স্যাটেলাইট ভিউতে গেলে দেখবেন, উদ্যানটির আশপাশে এত চওড়া সড়ক নেই।
ভাইরাল দুটি ছবির কোনোটিতেই এআই টুলের জলছাপ ছিল না। তবে ফিলিস্তিনের বিকৃত পতাকা, মানুষের সারিতে গাণিতিক প্যাটার্ন, ছোট ছোট অসংখ্য পতাকার একইভাবে ওড়া ও সমমিতিক বা সিমেট্রিক অবস্থান, উদ্যানের বদলে অস্বাভাবিক চওড়া সড়কে সমাবেশের চিত্রায়ন এবং মানুষের অবয়বে বৈচিত্রহীনতা — এসবই এআই দিয়ে তৈরি ছবির একেকটি সংকেত বহন করে।