তৌহিদুল ইসলাম রাসো
ড. ইউনূস কি ইসরায়েলের পুরস্কারকে ইউনেস্কোর নামে চালিয়েছেন?
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দাবি করা হচ্ছে ইসরায়েল থেকে একটি পুরস্কার পেয়ে সেটি ইউনেস্কোর বলে চালিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসব পোস্টের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনের লিংক বা স্ক্রিনশট, যার শিরোনাম, “ইসরাইল থেকে পুরস্কার পেয়ে ইউনেস্কোর বলে চালালেন ড. ইউনূস।” প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২৪ সালের মার্চে। সেসময় একাদশ বিশ্ব বাকু ফোরামে ট্রি অব পিস নামের একটি স্মারক সম্মাননা পেয়েছিলেন ড. ইউনূস। বাংলাদেশ থেকে ড. ইউনূস ছাড়াও ২০১৪ সালে এই স্মারক সম্মাননা পেয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে, ড. ইউনূসকে ট্রি অব পিস কার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল — তা নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এক বছর আগের সেই পুরোনো বিতর্ক আবার প্রাণ পেয়েছে এমন এক সময়ে যখন ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলা-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ উত্তাল হয়েছে ইসরায়েল-বিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে। ড. ইউনূস ইসরায়েল থেকে পাওয়া পুরস্কারকে জাতিসংঘের বলে চালিয়ে দিয়েছেন— এমন পোস্ট দিয়ে অনেকে ড. ইউনূসকে প্রতারক আখ্যা দিয়েছেন, কেউ আবার তাকে বয়কটের ডাক দিয়েছেন।
কিন্তু কী এই ট্রি অব পিস? এটি কি ইউনেস্কো বা ইসরায়েলের পুরস্কার? এটি দেওয়া হয় কার পক্ষ থেকে? এর আগে আরও কারা পেয়েছেন এই ট্রি অব পিস স্মারক? এই লেখায় এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে ডিসমিসল্যাব।
বিতর্কের সূত্রপাত যেভাবে
ট্রি অব পিস নামের স্মারকটি নিয়ে বিতর্ক প্রথম দানা বাঁধে ২০২৪ সালের মার্চে; ড. ইউনূস স্মারকটি পাওয়ার পর। তখন ইউনূস সেন্টার একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করে, তিনি “ইউনেস্কো থেকে ট্রি অব পিস পুরস্কার গ্রহণ করেছেন।” এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও (১, ২, ৩, ৪, ৫) বলা হয় যে, ড. ইউনূস ইউনেস্কোর ট্রি অব পিস পুরস্কার পেয়েছেন।

আর এর জবাবে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরি অভিযোগ করেন যে ড. ইউনূস একজন ইসরায়েলি ভাস্করের দেওয়া সম্মাননাকে প্রতারণামূলকভাবে ইউনেস্কোর পুরস্কার বলে প্রচার করছেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ২৭ মার্চ দৈনিক যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় “ইসরাইল থেকে পুরস্কার পেয়ে ইউনেস্কোর বলে চালালেন ড. ইউনূস” শিরোনামে। এক বছর আগে প্রকাশিত এই সংবাদের লিংক ও স্ক্রিনশট এখন শেয়ার হতে দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
পুরোনো এই বিতর্ক নিয়ে ফেসবুকে পুনরায় আলোচনা শুরু হয় গাজায় চলমান ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের সময়ে। গাজার বাসিন্দাদের ডাকা “গ্লোবাল স্ট্রাইক ফর গাজা” আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ৭ এপ্রিল “নো ওয়ার্ক, নো স্কুল” কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে ফেসবুকের একাধিক পেজ (১, ২, ৩), প্রোফাইল (১, ২, ৩) গ্রুপে (১, ২) দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট, লিঙ্ক শেয়ার করে বলা হচ্ছে ইসরায়েল থেকে ওই পুরস্কারটি পেয়ে সেটি ইউনেস্কোর বলে দাবি করেছেন ড. ইউনূস। একই দাবিতে সেটি শেয়ার করা হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও।

ট্রি অব পিস কি ইসরায়েল বা ইউনেস্কোর পুরস্কার?
ট্রি অব পিস নামের স্মারকটিকে ইসরায়েলের পুরস্কার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত একাধিক সংবাদমাধ্যমের (১, ২) শিরোনামে। যদিও এর সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক ছিল না। স্মারকটি মূলত ইউনেস্কোর শুভেচ্ছাদূত ও ফরাসি শিল্পী হেদভা সেরের একটি ভাস্কর্যের প্রতিলিপি, যা ইউনেস্কোর কাছে যেটি শান্তির অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময় তারা এটিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রচার করেছে এবং কখনো কখনো রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং শান্তিতে অবদানের রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এই স্মারক দেওয়া হয়েছে। ভাস্কর্য হিসেবে বিভিন্ন শহরে স্থাপন, স্মারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রদান ছাড়াও অন্য প্রতিযোগিমূলক অনুষ্ঠানের পুরস্কার হিসেবে এই ‘ট্রি অব পিস’ দেওয়ার চল আছে।
ইউনেস্কোর ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ২০১৫ সালে সংস্থার সচিবালয় একটি কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যেখানে ইউনেস্কোর ইতিহাসের ওপর ৭০টি প্রশ্ন করা হয়। উক্ত কুইজে বিজয়ী হয়েছিলেন ইউলিয়া প্লাখুটিনা। তিনি ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট ফর ইনফরমেশন টেকনোলজিস ইন এডুকেশনে (ইউনেস্কো আইআইটিই) কাজ করেন। কুইজে বিজয়ীর পুরস্কার হিসেবে ব্রোঞ্জের “শান্তি বৃক্ষ” স্মারক পেয়েছিলেন তিনি।

এছাড়া একাধিক অনলাইন কেনাকাটার ওয়েবসাইটে স্মারকটি বিক্রি হতে দেখা যায়। উক্ত ওয়েবসাইটগুলো থেকে স্মারকটি যে কেউ কিনতে পারেন। প্রতিটি ওয়েবসাইটেই স্মারকটির মূল্য ২৩০০ ইউরো বলা হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ৩ লাখ ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ এটি ইসরায়েলের কোনো পুরস্কার নয়, বরং যেকোনো প্রতিষ্ঠান, দেশ বা ব্যক্তি এটি পুরস্কার-সম্মাননা হিসেবে প্রদান করতে পারেন।
ট্রি অব পিস নামের এই স্মারকটি ইউনেস্কোরও কোনো পুরস্কার নয়, যেমনটি ২০২৪ সালে দাবি করা হয়েছিল ইউনূস সেন্টারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। এ নিয়ে তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী প্রতিবাদ করার পর ইউনূস সেন্টার আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, “বাকু ফোরামের আয়োজক নিজামী গানজাভি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের মহাসচিব রভশান মুরাদভ প্রফেসর ইউনূসকে পাঠানো ইমেইলে জানান যে এই সম্মেলনে বক্তব্য রাখা ছাড়াও এর সমাপনী দিনে প্রফেসর ইউনূসকে ইউনেস্কোর একটি পুরস্কার প্রদান করা হবে।”
“ট্রি অব পিস” স্মারকটি ড. ইউনূসকে পুরস্কার হিসেবে ইউনেস্কো দিয়েছিল কি না সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইউনেস্কোর মূল অফিসে ইমেইল করেছিল ডিসমিসল্যাব। জবাবে ইউনেস্কোর এক মুখপাত্র জানান, ট্রি অব পিস শিল্পী হেদভা সেরের তৈরি একটি ভাস্কর্য। হেদভা সের ইউনেস্কোর একজন শুভেচ্ছাদূত কিন্তু তার এই শিল্পকর্মটি ইউনেস্কোর কোনো অফিসিয়াল পুরস্কার নয়।
২০২৪ সালে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছাদূত হেদভা সেরকে ইসরায়েলি ভাস্কর বলে উল্লেখ করেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরি। তবে হেদভা সের ইসরায়েলে জন্মগ্রহণ করলেও তাকে ফরাসী ভাস্কর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ইউনেস্কোর অফিসিয়াল সাইটে।
‘ট্রি অব পিস’ আসলে কী?
ট্রি অব পিস মূলত ইসরায়েলে জন্ম নেওয়া ফরাসী ভাস্কর হেদভা সেরের একটি ভাস্কর্য। শান্তির বার্তা দিতে প্রথম ট্রি অব পিস স্থাপন করা হয় ২০০৭ সালের ৩০ ডিসেম্বরে, জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটি ও হাদাসাহ হাসপাতালের মধ্যবর্তী পাহাড়ের সমতল স্থানে। জেরুজালেমের পর ফিলিস্তিন, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, মালটা, বাকু, বার্লিন, প্যারিস, এথেন্স ও আবুধাবিসহ অনেক শহরেই এটি স্থাপন করা হয়।

সাধারণত জনসমাগমপূর্ণ জায়গায় ট্রি অব পিস বা “শান্তিবৃক্ষ” স্থাপন করা হয়। হেদভা সেরের ওয়েবসাইটে এই স্মারককে পৃথিবীর সব জাতির মধ্যে সমঝোতা, সংঘাত নিরসন এবং সকল মানুষের মধ্যে শান্তি উদযাপনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
শান্তিবৃক্ষ বা ট্রি অব পিস ইউনেস্কোর কাছে শান্তির অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। যার ফলে বিভিন্ন সময় তারা এটিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রচার করেছে এবং কখনো কখনো স্মারক হিসেবে বিশ্বে রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং শান্তিতে অবদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে।
“ট্রি অব পিস” নামের এই ভাস্কর্য-স্মারকটি বাংলাদেশের দুইজন ব্যক্তি পেয়েছেন: ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ২০২৪ সালে ড. ইউনূস। এছাড়াও আলজেরিয়ান শিল্পী রাচিদ কোরাইচি, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর কূটনীতিক এবং জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সভাপতি ডেনিস ফ্রসেস, ফিনল্যান্ড ও সার্বিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি ম্যাডাম টারজা হ্যালোনেন এবং বরিস ট্যাডিক তাদের অসামান্য কাজের জন্য স্মারকটি পেয়েছিলেন। এছাড়া শান্তির জন্যে কাজ করে যাওয়া আরও অনেক ব্যক্তিত্ব এই সম্মানজনক স্মারক পেয়েছেন।
ভাস্কর্যটি সম্পর্কে এই শিল্পীর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়, এর “শাখাগুলো আকাশের দিকে প্রসারিত এবং এমন প্রতীকে পরিপূর্ণ যা সবাইকে কাছাকাছি আনতে এবং সকল মানুষের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চায়।” এর প্রথম উপাদান হল “চাই”, যা বাইবেলে জীবনকে বোঝায়। দ্বিতীয় উপাদানটি হল “শিন”, যা হিব্রুতে “শালোম” এবং আরবীতে “সালাম” শব্দের প্রথম অক্ষর, যার অর্থ হল শান্তি। তৃতীয় উপাদান হল, বৃক্ষের শাখায় ডানা মেলার অপেক্ষায় থাকা একটি ঘুঘু পাখি যা শান্তির বাণী ছড়ায় এবং সবশেষে একটি বাঁকা চাঁদ, যা ইসলাম ধর্মের প্রতীক।
কে এই ভাস্কর হেদভা সের?
হেদভা সের একজন ফরাসি শিল্পী যিনি ইসরায়েলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার শৈল্পিক কাজের মধ্যে রয়েছে ট্যাপেস্ট্রি, জুয়েলারি এবং পেইন্টিং। তবে তিনি তার মনোমুগ্ধকর ভাস্কর্যের জন্য সুপরিচিত। তার ব্রোঞ্জের ভাস্করগুলো প্রকৃতির দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং শান্তি ও সহনশীলতা প্রচারের লক্ষ্যে তৈরি।

মানুষের মাঝে শান্তি এবং জাতির মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি তার ভাস্কর্য ‘ট্রি অব পিস’ ২০০৭ সাল থেকে সারা বিশ্বে উদ্বোধন শুরু করেন এই ফরাসি ভাস্কর। ২০১১ সালে তিনি ইউনেস্কো ‘আর্টিস্ট ফর পিস’ উপাধিতে ভূষিত হন। আর ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছাদূত এবং সংস্কৃতি কূটনীতির বিশেষ দূত হিসেবে মনোনীত হন।
তবে শুভেচ্ছাদূত কিংবা আর্টিস্ট ফর পিস খেতাব পাওয়া শিল্পীরা ইউনেস্কোর কোনো অফিসিয়াল কর্মকর্তা নন। তারা শুধু তাদের কাজের মাধ্যম ইউনেস্কোর কর্মসূচি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ান। একবার নিযুক্ত হয়ে গেলে তারা তাদের প্রতিভা এবং খ্যাতি ব্যবহার করে ইউনেস্কোর অধিকতর মূল্যবোধ এবং লক্ষ্যগুলো বহন করতে সম্মত হন। ইউনেস্কোর শুভেচ্ছাদূত প্রোগ্রাম তাদের পদক্ষেপগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে সহায়তা করে। কিছু ক্ষেত্রে তহবিল সংগ্রহের জন্যও সাহায্য করে।