উসামা রাফিদ

যেভাবে সহজেই যাচাই করা যেত আইপিডির ভুতুড়ে লেখকদের
উসামা রাফিদ
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ম্যাগাজিন ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের (আইপিডি) ভুতুড়ে লেখকদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ডিসমিসল্যাবে। এজন্য একটি ভুয়া লেখক তৈরি করে তার নামে সেই ওয়েবসাইটে একটি লেখাও ছাপানো হয়েছিল। ডিসমিসল্যাবের তৈরি করা সেই ভুয়া লেখকের নাম ছিল সারাহ সুনেহরা জামান। এই লেখক যে ভুয়া সেটি একজন ফ্যাক্টচেকার ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধান প্রকাশের আগেই ধরে ফেলেছিলেন। পড়ুন কীভাবে।
গত ২৪ মার্চ (সোমবার) যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার নোটিফিকেশন আসে আমার মোবাইল ফোনের নিউজ অ্যাগ্রেগেটরে। শুরুতেই প্রতিবেদনটির শিরোনাম আমার নজর কাড়ে। বাংলাদেশ নিয়ে ডিসইনফরমেশন বা অপতথ্যের শিকার হয়েছেন যুক্তরাজ্যের এমপিরা! সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক করে প্রতিবেদনটি বিস্তারিত পড়া শুরু করতেই বিষয়টি ধীরে ধীরে খোলাসা হতে শুরু করল।
ইমেইলের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের এমপিদের কাছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে অপতথ্যে ভরপুর কিছু ওয়েবসাইট লিঙ্ক পাঠানো হয়েছে, আর সেটিও আবার বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য ড. মনসুর যখন লন্ডনে তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন ঠিক তার আগে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্ট ওয়েবসাইটটির নামের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। এর আগে কখনো এই নামের ওয়েবসাইট চোখে পড়েনি। গভর্নর মনসুরকে নিয়ে ঠিক কী লেখা হয়েছে সেই আর্টিকেলটি খুঁজে বের করার জন্য গুগলে ওয়েবসাইট অপারেটর আর গভর্নরের নাম সার্চ দিতেই [site:intpolicydigest.org “Mansur”] চলে আসল কাঙ্ক্ষিত লিঙ্কগুলো।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন পড়েই জেনেছিলাম ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর লেখকরা ভুয়া নাম ব্যবহার করছেন এবং তাদের প্রোফাইলের ছবিগুলোও স্টক ইমেজ থেকে ধার করা। সত্যিই তাই! গুস্তাভ এলিসন নামের লেখকের পাশে যে ছবি আছে, সেটির স্ক্রিনশট নিয়ে গুগল ও ইয়ানডেক্সে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে নিশ্চিত হওয়া গেল ছবিটা স্টক ইমেজের ওয়েবসাইট থেকেই নেওয়া।
লেখকদের নকল প্রোফাইল নিশ্চিত হওয়ার পর আমি খোঁজার চেষ্টা করলাম এই ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ নিয়ে আর কারা কারা প্রতিবেদন লিখেছেন। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রকাশ হওয়া প্রতিবেদনগুলোকে বিশ্লেষণ করার জন্য গুগলের অ্যাডভান্সড সার্চ অপশনে গিয়ে একইভাবে ওয়েবসাইট অপারেটর [site:intpolicydigest.org] এবং ‘Bangladesh’ কিওয়ার্ডের সঙ্গে সময় ঠিক করে দিলাম ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ শব্দটি রয়েছে এরকম মোট ১৬টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এমন ফলাফল উঠে আসল গুগলের সার্চ রেজাল্ট থেকে।

এরপরের উদ্দেশ্য এই ১৬টি আর্টিকেলের মধ্যে কয়টি নকল প্রোফাইলের লেখকদের লেখা, সেটি খুঁজে বের করা। ১৬টির মধ্যে ৭টি প্রতিবেদনের লেখকদের প্রোফাইল পিকচার দেখেই নিশ্চিত হওয়া গেল এগুলো নকল, কারণ এগুলোর কোনোটিরই আলাদাভাবে লেখক পরিচিতি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেবল স্টক ইমেজ আর বিদেশি নাম। এই ৭টি প্রতিবেদনে মোট ৫ জনের নাম খুঁজে পাওয়া গেল: টিম লারকিন, ক্রিস্টোফার ও’ব্রায়েন, গুস্তাভ এলিসন, থমাস ইব্রাহিম এবং উইলিয়াম ফ্রাই। যাদের মধ্যে টিম লারকিন ও গুস্তাভ এলিসনের নামে দুইটি করে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি প্রতিবেদনের ওয়েবলিঙ্ক, শিরোনাম, লেখকের নাম, তারা আসল নাকি নকল, লেখক পরিচিতি আছে নাকি নেই, লেখার মূল বক্তব্যের ভাষ্য কেমন এবং প্রতিটি প্রতিবেদন যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য ওয়েবলিঙ্ক আর্কাইভ করার পর আর্কাইভকৃত লিঙ্কের ডেটাবেজ তৈরি করতে সময় লেগেছে আনুমানিক দেড় ঘণ্টা।
এই ডেটাবেজ তৈরি করার পর তালিকায় থাকা নকল ৭টি প্রতিবেদনের বাইরের আরেকটি নাম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অন্যান্য নকল প্রোফাইলের প্রতিবেদনগুলোর মতো এটিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে লেখা। তবে বাকিগুলোর সঙ্গে এই প্রতিবেদনটির মূল পার্থক্য হলো লেখকের নামটি বাংলাদেশি এবং এই প্রোফাইলটির সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি যুক্ত করা আছে। এই লেখকের নাম সারাহ সুনেহরা জামান। পরিচিতিতে লেখা রয়েছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং একইসঙ্গে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) একজন সাবেক ফেলো।
এই পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রথমেই পুরো নামটি লিখে গুগলে সার্চ করলাম, কিন্তু কেবল ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের প্রোফাইল লিঙ্ক এবং ঐ ওয়েবসাইটে তার লেখা প্রতিবেদনটি ছাড়া আর তেমন কিছুই গুগলের ফলাফলে আসেনি। সারাহ বা জামান নামের আরো কিছু সামাজিক মাধ্যমের লিঙ্ক থাকলেও হুবহু সারাহ সুনেহরা জামান নামে আর কোনো সামাজিক মাধ্যমের লিঙ্ক বা অন্যান্য তথ্য খুঁজে পেলাম না।
বিষয়টি সম্পর্কে আরেকটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য লেখক পরিচিতির ছবির স্ক্রিনশট নিয়ে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করার পরও কেবল ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের ওয়েবসাইটটিই প্রদর্শন করছিল। তবে এই ছবিটির মান দেখে তা এআই জেনারেটেড হওয়ার সম্ভাবনার সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল।
এআই জেনারেটেড ছবি কি না তা পরীক্ষা করার জন্য এআই ইমেজ ডিটেকশন টুল সাইটইঞ্জিনের সহায়তায় নিশ্চিত হলাম ছবিটি এআই ইমেজ জেনারেটর স্টেবল ডিফিউশনের মাধ্যমে তৈরি। অর্থাৎ, ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের এই প্রতিবেদনের লেখকও নকল।

শেষমেশ বিষয়টি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা দুইজনই বললেন সারাহ সুনেহরা জামান নামটির সঙ্গে তারা পরিচিত নন এবং প্রোফাইলটি নকল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এই নামে অন্য কোনো ওয়েবসাইটে লিঙ্ক না পাওয়া, এআই দিয়ে তৈরি প্রোফাইল পিকচার এবং একইসঙ্গে পরিচিতিতে থাকা তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেল যে এই আর্টিকেলটিও কোনো ভুতুড়ে লেখকের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানটি শুরু করার ঠিক পরদিনই অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন থেকে জানতে পারলাম এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তারা ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের ওপর নজর রাখছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ তারা বিকৃত তথ্যযুক্ত একটি প্রতিবেদন লিখে পাঠায় সারাহ সুনেহরা জামানের নামে। এই নকল নামের সঙ্গে তারা একটি এআই-জেনারেটেড ছবি জুড়ে দেয়, সঙ্গে যুক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচয়, যা খুব সহজেই সম্পাদক পর্ষদ ক্রসচেক করে নিতে পারতেন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এমন স্বল্পপরিচিত আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটগুলোকে ব্যবহার করা হলেও আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, এই ওয়েবসাইটকে মূলসূত্র ধরেই অপতথ্যগুলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিস্তৃত আকারে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের কিছু গণমাধ্যম এবং ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে। যেমন: টিম লারকিনের নামে প্রকাশিত “এ হাউজ অব গ্লাস: দ্য হিপোক্রেসি অব বাংলাদেশ ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট” শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রথম বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বিডি ডাইজেস্ট নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। এর পরদিনই ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকাটি তাদের ওয়েবসাইটে গভর্নরের মেয়ে মেহরীন সারাহ মনসুরের দুবাইয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। একই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ফার্স্ট, বার্তাটুয়েন্টিফোর, দৈনিক জনকণ্ঠ এবং এসএ টিভি।
গণমাধ্যমের নরম্যাটিভ তত্ত্বানুযায়ী, প্রতিটি গণমাধ্যমেরই দায়িত্ব প্রতিটি প্রকাশিত তথ্য যাচাই করে নেওয়া, সেটি যত বড় প্রভাবশালী গণমাধ্যমই হোক না কেন। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের মতো একেবারেই স্বল্পপরিচিত গণমাধ্যমের তথ্য কোনো ধরনের ক্রসচেক না করেই সরাসরি অনুবাদ করে প্রকাশ করা কেবল সামগ্রিক গণমাধ্যমকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, একইসঙ্গে সমাজে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা অন্যান্য পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক মেরুকরণেও ভূমিকা রাখে, যার পরিণতি হতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা রাজনৈতিক সংঘাত।
এ কারণে রাজনৈতিক বা ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশের আগে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এবং এমন যাচাই করা যে খুব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তা-ও নয়। ভেরিফিকেশন করার জন্য খুব বেশি বাড়তি প্রযুক্তিগত দক্ষতারও প্রয়োজন নেই, গুগল সার্চ অপারেটরের ব্যবহারই যথেষ্ট। তবে সবচেয়ে বেশি যা জরুরি তা হলো, একজন সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু মন এবং সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান। নতুবা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের মুখপাত্র যেভাবে অপতথ্যে ভরপুর প্রতিবেদনকে ‘যথেষ্ট পরিমাণ ঠিক’ বলে নিজের গণমাধ্যমের নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোও তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ “বিশ্বাসযোগ্যতা” আরো হারানোর ঝুঁকিতে থাকবেন।