আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবীকে নিয়ে দেশি-বিদেশী গণমাধ্যমে ভুল দাবি

চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবীকে নিয়ে দেশি-বিদেশী গণমাধ্যমে ভুল দাবি

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ২৫ নভেম্বর, সোমবার বিকালে গ্রেফতার করা হয় ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে তোলা হলে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। এসময় আদালতের আশেপাশে বিক্ষোভ করতে থাকে চিন্ময় দাসের অনুসারীরা এবং এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষ চলাকালে জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও আদালতের প্রবেশ সড়কে সাইফুল ইসলাম আলিফসহ কয়েকজনের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় সাইফুল ইসলাম আলিফকে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই হত্যার ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে বিভিন্ন রকমের দাবি ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচার হতে শুরু করে যে নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফ ছিলেন প্রভু চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পক্ষের উকিল। একইসাথে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় যে তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন। তবে যাচাইয়ে দেখা যায় সাইফুল ইসলাম আলিফ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন না।

দেশি গণমাধ্যমে ভুল দাবি

বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমে সাইফুল ইসলাম আলিফের পরিচয় দেওয়া হয়েছে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) হিসেবে। যুগান্তর, আজকের পত্রিকা, প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন, ডিবিসি নিউজ, আরটিভি, সমকাল, ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয় যে সাইফুল ইসলাম আলিফ ছিলেন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর অথবা সহকারী সরকারি কৌঁসুলি। এছাড়া ইউটিউবে দৈনিক যায়যায়দিন এবং চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের ভিডিও প্রতিবেদনেও এই তথ্যটি উঠে আসে। কয়েকটি প্রতিবেদনে বলা হয় তিনি এপিপি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এক মাস আগে।

তবে কালের কন্ঠের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক বলেন, ‘উনি চট্টগ্রাম বারের রেগুলার আইনজীবী ছিলেন। পাঁচ-ছয় বছর প্রফেশনে আছেন, ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে প্র্যাকটিসে আছেন। গত বছর হাইকোর্ট বারে সনদ পেয়েছেন।’ তবে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমে তাকে সহকারী কৌঁসুলি হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তিনি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ছিলেন না বলেও জানান তিনি।”

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করলে চট্টগ্রাম জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরি জানান যে সাইফুল ইসলাম আলিফ এপিপি ছিলেন না। তিনি সাধারণভাবেই চট্টগ্রাম জেলা আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ডিসমিসল্যাব আরও যোগাযোগ করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মফিজুল হক ভূঁইয়ার সাথে। তিনি নিশ্চিত করেন যে সাইফুল ইসলাম আলিফ পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন না। তবে প্রায় একই নামের একজন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর আছেন মহানগর দায়রা জজ আদালতে। তার নাম সাইফুল ইসলাম চৌধুরি। পিতার নাম ইউসুফ চৌধুরি। অপরদিকে সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফের পিতার নাম হলো জামাল উদ্দিন সওদাগর। এর পাশাপাশি ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে সাইফুল ইসলাম আলিফের বন্ধু উম্মুল হায়াত অপির সাথে। তিনিও চট্টগ্রাম জেলা আদালতের একজন আইনজীবী। অপি জানান যে নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফ এপিপি ছিলেন না। 

চলতি বছরের অক্টোবরে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং এদের অধীন আদালতসমূহ, বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত এবং বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রাইব্যুনালে নিয়োগকৃত আইন কর্মকর্তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করে সলিসিটর অনুবিভাগ। ১৬ অক্টোবর তারিখে উপ-সলিসিটর সানা মোঃ মাহরুফ হোসাইন স্বাক্ষরিত এই তালিকা যাচাই করেও দেখা যায় এখানে সাইফুল ইসলাম আলিফের নাম নেই। এই তালিকাটির পর নতুন কোন তালিকা প্রকাশ হয়নি বলে জানান পাবলিক প্রসিকিউটর মফিজুল হক ভূঁইয়া।

তবে তালিকাটিতে এপিপি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের মধ্যে দুজনের নাম সাইফুল দেখা যায়। এদের মধ্যে মহানগর দায়রা জজ আদালতের এপিপি সাইফুল ইসলাম চৌধুরি, পিতা ইউসুফ চৌধুরি এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এপিপি সাইফুল আলম, পিতা শামসুল আলম। দুজনের সাথেই যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব নিশ্চিত হয় যে তারা কেউই নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফের সাথে সংশ্লিষ্ট নন।

এছাড়া, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম অফিসিয়াল ফেসবুক পোস্টে বলেন, “আমরা চট্টগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটরসহ আধ ডজন আইনজীবীর সাথে কথা বলেছি নিশ্চিত হতে যে তিনি (সাইফুল ইসলাম আলিফ) জনাব দাসের আইনজীবী ছিলেন না। আমাদের হাতে পিপি এবং এপিপির তালিকাও আছে। এখানেও তার নাম নেই।”

এছাড়া বিক্ষোভ মিছিলের ব্যানারেও সাইফুল ইসলাম আলিফকে চট্টগ্রামের আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে উল্লেখ করতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমের কিছু পোস্টে (, )।

গণমাধ্যমের বরাত ধরে এই ভুল তথ্যটি চলে আসে বিভিন্ন ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনেও। বাংলাদেশের একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের (, , , ) প্রতিবেদনে এই ভুল তথ্যটি দেখা যায়। তবে ভারতের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান বুম ইন্ডিয়া চট্টগ্রাম জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরির সাথে এবং অল্ট নিউজ একই বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আশরাফ হোসাইন চৌধুরি রাজ্জাকের সাথে যোগাযোগ করে। এই দুজনই এই ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান দুটিকে নিশ্চিত করেন যে, সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রামের কোন আদালতের এপিপি ছিলেন না।

বিদেশি গণমাধ্যমে ভুল দাবি

সোমবার, ২৬ নভেম্বর দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে সামাজিক মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ ভারতীয় চিত্রনাট্যকার এবং কলামিস্ট অদ্বৈত কালা লিখেন, “আতঙ্কজনক – চিন্ময় প্রভুর পক্ষের উকিলকে হত্যা। হিন্দুরা বাংলাদেশে নিরাপদ না এবং যারা তাদের পক্ষে তারাও না। এই উপমহাদেশে হিন্দুদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় হলো ভারত।” ভয়েজ অব বাংলাদেশি হিন্দুজ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়, “চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর পক্ষ সমর্থনে আসা মুসলিম আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা হত্যা করেছে।” এছাড়া মেঘ আপডেট নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকেও একই দাবিতে রিপাবলিক টিভির একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়।

অদ্বৈত কালার পোস্টটির কিছুক্ষন পরেই ভারতীয় গণমাধ্যম রিপাবলিক টিভির অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে বলা হয়, “ইসকনের চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পক্ষ সমর্থনকারী মুসলিম আইনজীবী খুন।” বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ২ মিনিটে রিপাবলিক টিভির প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আদালতের বাইরে পুলিশের গুলিতে হিন্দু পুরোহিত কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হয়েছে।” রিপাবলিক টিভির পোস্ট করা ভিডিওটি ব্যবহার করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভারতের ডানপন্থী গণমাধ্যম ওপইন্ডিয়া।

এই হত্যার ঘটনায় ভুল বার্তা দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে রয়টার্স। “বাংলাদেশে পুলিশের সাথে হিন্দু আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে নিহত একজন”- শিরোনামে প্রকাশিত এই সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, “পুলিশ অফিসার লিয়াকত আলী বলেছেন, ‘(চট্টগ্রামে) কোর্টের বাইরে হওয়া সংঘর্ষের মধ্যে দাসের পক্ষ সমর্থনকারী একজন উকিল নিহত হয়েছে।” একই উক্তি ব্যবহার করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে লাইভমিন্ট, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য প্রিন্ট, হিন্দুস্তান টাইমস, ভয়েজ অফ আমেরিকা, আরব নিউজ। এই উক্তিটির সবচেয়ে পুরোনো সূত্রটি পাওয়া যায় রয়টার্সের প্রতিবেদনেই। ইতিমধ্যে রয়টার্স দুই বার সংশোধনী দিয়ে প্রতিবেদনে পরিবর্তন এনেছে। তবে বেশকিছু গণমাধ্যমে এখনও এই উক্তিটি দেখা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখিত উক্তিটিকে অসত্য দাবি করে বলা হয়, “রয়টার্স বা কোনো সাংবাদিক এই বিষয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) লিয়াকত আলী খানের সাথে কথা বলেননি। ঘটনার সময়ে তিনি আদালত প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কাজে দায়িত্বরত ছিলেন। লিয়াকত নামে চট্টগ্রামে চার জন কন্সটবল আছে। তারাও কাউকে কোনো বক্তব্য দেননি। কারো বক্তব্য গ্রহণ না করেই নিজেদের মনগড়া বক্তব্যকে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য বলে চালিয়ে দেওয়া সাংবাদিকতার নীতিমালা পরিপন্থী।”

আইনজীবী হিসেবে চট্টগ্রাম আদালতে প্র্যাক্টিস করতেন তিনি। তিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর পক্ষ সমর্থনকারী উকিল ছিলেন না। এছাড়াও আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পেশকৃত ওকালতনামা থেকে দেখা যায় যে তার আইনজীবীর নাম অ্যাডভোকেট শুভাশীষ শর্মা

এছাড়া, এই ঘটনাকে কেন্দ্র আরেকটি দাবি করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। ডাল্টন সৌভাত হীরা নামের একজন ব্যবহারকারী একটি পোস্টে দাবি করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০ জন লোক নিখোঁজ হয়েছেন। তবে এই দাবির সাপেক্ষে কোন সূত্র বা প্রমাণ তিনি দেননি। পোস্টে পার্থ চক্রবর্তী নামের একজনের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য দিয়ে কমেন্টে একটি লিংক দিলেও লিংকটি আর কার্যকর নেই। তাছাড়া তিনি একজনের মন্তব্যের জবাবে বলেছেন উল্লিখিত নিখোঁজ ব্যক্তিকে পাওয়া গিয়েছে। ডাল্টন সৌভাত হীরার বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। তবে ডাল্টন সৌভাত হীরার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের অক্টোবরে বুম বাংলাদেশের একটি প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময়ে অপতথ্য ছড়ানোর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

আরো কিছু লেখা