ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
সমন্বয়ক তরিকুলের বক্তব্য সম্পাদিত করে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রচার

সমন্বয়ক তরিকুলের বক্তব্য সম্পাদিত করে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রচার

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মোঃ তরিকুল ইসলামের বক্তব্য বিকৃত করে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়াতে দেখা গেছে। ভিডিওতে তরিকুলকে অপর দুই সমন্বয়ক সারজিস ও হাসনাতের বাসা থেকে শতকোটি টাকা উদ্ধারের দাবিসহ অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করতে শোনা যায়। বক্তব্যের শেষ দিকে শেখ হাসিনা সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় আসার আহ্বান করেন তরিকুল। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, ভিডিওটি পুরোপুরি সম্পাদিত। গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীতে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় মো. তরিকুল ইসলাম একটি বক্তব্য রাখেন। তার মূল বক্তব্য থেকে সাতটি খণ্ডিত অংশ জোড়া দিয়ে সম্পাদিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়, যার ফলে পুরো বক্তব্যের অর্থই বদলে যায়।

সম্প্রতি “সারজিসের বাসায় ২০০ কোটি! হাসনাতের বাসায় ১০০ কোটি!!”– দাবিতে ইউটিউব ও ফেসবুকে (, , , , , ) ৪৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছড়াতে দেখা যায়। ভিডিওটিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুলকে মাইক হাতে বক্তৃতায় বলতে শোনা যায়, “আমাদের কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। চতুর্দিক থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সারজিসের বাসায় ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। হাসনাতের বাসায় ১০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। যে অবিশ্বাসের রাজনীতি শুরু করা হয়েছে সে রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব আপনারা উপদেষ্টা পদ আপনারা ছেড়ে দিন। আড়াই মাস হয়ে গিয়েছে সবজির দাম বেড়েছে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিয়ে আমরা কি করব? তাই আমরা বলতে চাই, আমাদের সজাগ থাকতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার বারে বারে দরকার। ঠিক কি না?” সবগুলো ভিডিওর ভেতরের ক্যাপশনে ইংরেজিতে কবির চৌধুরী তন্ময়ের নাম উল্লেখ রয়েছে। এ প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত কবির চৌধুরী তন্ময় নামের একটি ভেরিফায়েড আইডি থেকে ছড়ানো মূল ভিডিওটি ফেসবুকে ২৬ হাজারের বেশিবার দেখা হয়েছে।

ভিডিওটি যাচাই করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্যসচিব মোঃ তরিকুল ইসলামের মূল বক্তব্যের ভিডিও খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। গত ১৮ অক্টোবর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৃহত্তর মিরপুর কর্তৃক আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ বক্তব্যটি রাখেন। তরিকুলের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে তার মূল বক্তব্যের দীর্ঘ ৯ মিনিটের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। 

৯ মিনিটের ভিডিওটি যাচাইয়ে দেখা যায়, মূল বক্তব্যের সাতটি অংশ আলাদাভাবে নিয়ে ৪৬ সেকেন্ডের সম্পাদিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মূল ভিডিওতে তারিকুলের বক্তব্যে এই একই কথাগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বলা ছিল। 

মূল বক্তব্যের একটি অংশে তরিকুল অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “চতুর্দিক থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সারজিসের বাসায় ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। হাসনাতের বাসায় ১০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। যে অবিশ্বাসের রাজনীতি শুরু করা হয়েছে সে রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। আপনাদেরকে বুঝতে হবে অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের শক্ত, নৈতিক মানদন্ড না থাকলে তারা কখনো এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে পারতো না।” প্রথম কয়েকটি লাইন সম্পাদিত ভিডিওতে রাখা হলেও, শেষ লাইনটি কেটে ফেলা হয়। যার ফলে মনে হয় সারজিস ও হাসনাতের দুর্নীতির সমালোচনা করছেন তরিকুল।

কেটে নেওয়া অংশমূল বক্তব্যসময়
আমাদের কেও দাবায় রাখতে পারবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সে লড়াই শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে কেও দাবায় রাখতে পারবে না।০৮:৪৫ মিনিট হতে ০৮:৫৬ মিনিট
চতুর্দিক থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সারজিসের বাসায় ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। হাসনাতের বাসায় ১০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। যে অবিশ্বাসের রাজনীতি শুরু করা হয়েছে সে রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।চতুর্দিক থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সারজিসের বাসায় ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। হাসনাতের বাসায় ১০০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। যে অবিশ্বাসের রাজনীতি শুরু করা হয়েছে সে রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। আপনাদেরকে বুঝতে হবে অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের শক্ত, নৈতিক মানদন্ড না থাকলে তারা কখনো এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে পারতো না।০৮:৫৭ মিনিট হতে ০৯:২৫ মিনিট
আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব আপনারা উপদেষ্টা পদ আপনারা ছেড়ে দিন। যেসব সন্ত্রাসীরা আমাদের ভাইদেরকে হত্যা করেছে, আমাদের বোনদেরকে স্বামীহারা করেছে, আমাদের মায়েদের বুক খালি করেছে– সেসব সন্ত্রাসীদের, হত্যাকারীদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। তাদেরকে যদি গ্রেফতার করা না হয় আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব আপনারা উপদেষ্টা পদ আপনারা ছেড়ে দিন। ০২:২৫ মিনিট হতে ০২:৫১ মিনিট
আড়াই মাস হয়ে গিয়েছে সবজির দাম বেড়েছে।আড়াই মাস হয়ে গিয়েছে মিরপুরে যারা টেন্ডারবাজী করেছে, সন্ত্রাসবাদ কায়েম করেছে, আমাদের ভাইদেরকে যারা হত্যা করে … ০২:৫৩ মিনিট
সবজির দাম বেড়েছে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো উত্তরবঙ্গে টানা চার বার বন্যা হয়নাই। এইবার টানা চার বার বন্যা হয়েছে। … ফসলের ক্ষতি হয়েছে, সবজির দাম বেড়েছে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে।০৬:১৬ মিনিট হতে ০৬:৩৭ মিনিট
তাহলে অন্তঃবর্তীকালীন সরকারকে দিয়ে আমরা কি করব?আমাদের ভাইদেরকে যারা হত্যা করে … তাদেরকে যদি গ্রেফতার করা না হয় তাহলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিয়ে আমরা কি করব। ০৩:০০ মিনিট হতে ০৩:১৬ মিনিট
তাই আমরা বলতে চাই, আমাদের সজাগ থাকতে হবে।কিন্তু এই ধরণের ফ্যাসিবাদের দোসর কি বিচার বিভাগে এখন পর্যন্ত আছে না? … আওয়ামী লীগ থেকে ভিক্ষা নিয়ে তারা সেখানে বসেছে। তারা যখনি সুযোগ পাবে তখনই তারা এ ভিক্ষার প্রতিদান দেওয়া শুরু করবে। তাই আমরা বলতে চাই, আমাদের সজাগ থাকতে হবে।০৩:৫৪ মিনিট হতে ০৪:২০ মিনিট
মূল বক্তব্য যেভাবে বদলে দেয়া হয়েছে

এছাড়া মূল বক্তব্যে ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি’-র পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সমালোচনা করে তরিকুল বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের দুই মাস না যেতেই তারা জজকোর্টে স্লোগান দিচ্ছে– শেখ হাসিনা সরকার বারে বারে দরকার। ঠিক কি না?”। সম্পাদিত ভিডিওটিতে এই বক্তব্যেরও খণ্ডিত অংশ জুড়ে পরিবর্তিত অর্থ দাঁড় করানো হয়েছে।

আরেকটি অংশে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের বিচারের আহ্বান জানিয়ে তরিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের মায়েদের বুক খালি করেছে– সেসব সন্ত্রাসীদের, হত্যাকারীদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। তাদেরকে যদি গ্রেফতার করা না হয় আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব আপনারা উপদেষ্টা পদ আপনারা ছেড়ে দিন। আড়াই মাস হয়ে গিয়েছে মিরপুরে যারা টেন্ডারবাজী করেছে, সন্ত্রাসবাদ কায়েম করেছে, আমাদের ভাইদেরকে যারা হত্যা করে … তাদেরকে যদি গ্রেফতার করা না হয় তাহলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিয়ে আমরা কি করব।” এই বক্তব্য থেকেও কিছু লাইন নিয়ে সম্পাদিত ভিডিওর মাঝে জোড়া হয়েছে যাতে মনে হয়, তারিকুল অন্তবর্তী সরকারের সমালোচনা করছেন।

পুরো বক্তব্যে তরিকুল বন্যার কারণে সবজি ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে উল্লেখ করে বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো উত্তরবঙ্গে টানা চার বার বন্যা হয়নাই। এইবার টানা চার বার বন্যা হয়েছে।…ফসলের ক্ষতি হয়েছে, সবজির দাম বেড়েছে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে।” দাম নিয়ে বাজার সিন্ডিকেটের সমালোচনার অংশকেই সম্পাদিত ভিডিওতে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা হিসেবে তুলে ধরা হয়।

এই বক্তৃতার শেষ দিকে তারিকুল সবার উদ্দেশ্যে জোড় গলায় বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সে লড়াই শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে কেও দাবায় রাখতে পারবে না।” সম্পাদিত ভিডিওতে এই বক্তব্য থেকেও অর্থ বিকৃত করে লাইন যুক্ত করা হয়েছে। 

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৃহত্তর মিরপুর– গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরের ফায়ার সার্ভিস মাঠে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। যেখানে কেন্দ্রিয় ছাত্র সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, তারিকুল ইসলাম ও আবদুল কাদের বক্তব্য রাখেন। আলোচ্য ভিডিওটিতে মূলত তারিকুলের মূল বক্তব্যের কিছু অংশ ক্লিপ আকারে কেটে, আগে পরে বসিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে সম্পাদিত করে প্রচার করা হয়েছে। 
ইতিপূর্বে সমন্বয়ক সারজিস আলমের বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধারের মিথ্যা দাবি করে গণমাধ্যমের নামে ভুয়া ফটোকার্ড ছড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে ফ্যাক্টচেক রিপোর্টও প্রকাশিত হয়।

আরো কিছু লেখা