ফাতেমা তাবাসুম
মণিপুরে ভারতীয় হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার দাবিতে মিয়ানমারের ভিডিও প্রচার
ফাতেমা তাবাসুম
ভারতের মণিপুর রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার জেরে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। এক সপ্তাহের বেশি সময় বন্দুকযুদ্ধ, ড্রোন ও রকেট হামলার পর এবার ভারতের মণিপুর রাজ্যের তিনটি জেলায় কারফিউ জারি করেছে রাজ্য সরকার। পাশাপাশি রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মাঝে বাংলাদেশে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে “সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত মণিপুরের স্বাধীনতাকামীরা ভারতীয় হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে” দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার হতে দেখা যায়। যদিও ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওটি পুরোনো এবং মূল ঘটনার সঙ্গে মণিপুরে চলমান সহিংসতার কোনো যোগসূত্র নেই।
গত ৯ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম– এর নাম ও পরিচয়ে তৈরি দুটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত হবার ভিডিও রিল প্রকাশ করা হয়। ক্যাপশনে দাবি করা হয় “সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত মণিপুরের স্বাধীনতাকামীরা ভারতীয় হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে”। আব্দুল্লাহ বিন সাইফুল নামক একজন ব্যবহারকারীকে একই তথ্য “>>ব্রেকিং নিউজ<<” আকারে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে (১, ২, ৩) পোস্ট করতে দেখা যায়। প্রতিটি পোস্টের নিচে মন্তব্যের ঘরে ‘আলোর পথে’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে থাকা ভিডিওটির একটি লিংক দিয়ে একই দাবি করেন। এর বাইরেও ফেসবুকে একই দাবিতে ভিডিওটি বিভিন্ন পেজ (১, ২, ৩) থেকেও পোস্ট হতে দেখা যায়।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ– এর পরিচয়ে পরিচালিত ফেক আইডি থেকে পোস্ট করা ভিডিওর নিচে একজন মন্তব্য করেন, “মাশাআল্লাহ চালিয়ে যাচ্ছে আমার ভাইয়েরা আলহামদুলিল্লাহ।” উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম– এর পরিচয়ে ফেক আইডি থেকে পোস্ট করা ভিডিওটির নিচে আরেক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “তাদের অভ্যন্তরে এতকিছু সংঘটিত হয় এবং তারা নিজেদের নাগরিকদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারে না অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে, বিষয়টি অত্যান্ত হাস্যকর।” উভয় ফেক আইডিই ১০ হাজারের বেশি মানুষ অনুসরণ করছেন। যদিও দুই উপদেষ্টা আসিফ ও নাহিদ– এর ভেরিফায়েড প্রোফাইলে এমন কোনো ভিডিও বা তথ্যের উল্লেখ নেই।
ভিডিওটির কি ফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে, মূল ভিডিওটির একটি ইউটিউব ক্লিপ খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হয়, “ফুটেজ: কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) মিয়ানমারের একটি সামরিক হেলিকপ্টারকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে।” ভিডিওটির বর্ণনায় বলা হয়, “সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) মিয়ানমারের শান রাজ্যের ওয়াইংমাউ শহরে একটি সামরিক হেলিকপ্টারকে (সম্ভবত একটি মিল এমআই- ১৭) গুলি করে ভূপাতিত করে। এফএন- ৬ (ফেইনু- ৬) ম্যান-পোর্টেবল এয়ার-ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছিল এই হামলায়, যা সম্ভবত ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ) থেকে প্রাপ্ত।”
পরবর্তীতে ডিসমিসল্যাব মিয়ানমার ভিত্তিক তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান “দ্য রেড ফ্ল্যাগ“– এর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে ঘটনাটির একটি নিউজ রিপোর্ট সংগ্রহ করেছে। মিয়ানমার ভিত্তিক নিউজ এজেন্সি ‘মিয়ানমার নাউ’– এর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে তারা ভিডিওটি শেয়ার করেন। আসল ঘটনা বার্মিজ ভাষায় লেখা পোস্টের ক্যাপশনকে গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্যে অনুবাদ করলে জানা যায়, সেখানে কেআইএর (KIA) একজন সৈনিক কাঁধে বহনযোগ্য বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক কাউন্সিলের একটি হেলিকপ্টারের দিকে গুলি চালায়, যা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বিধ্বস্ত হয়। কেআইএর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, এই ধারণকৃত ভিডিওটি এ বছরের ৩ জানুয়ারি ওয়াইংমাও টাউনশিপের নাফাউ অঞ্চলে অবস্থিত একটি সামরিক ক্যাম্পে রসদ সরবরাহ করতে আসা একটি হেলিকপ্টারকে গুলি করে ভূপাতিত করার ঘটনা। মূল দুর্ঘটনাটি মূলত ঘটেছিল মিয়ানমারে। পাশাপাশি ‘পিপলস স্প্রিং’– নামক একটি বার্মিজ নিউজ ওয়েবসাইটেও চার দিন আগের একটি প্রতিবেদন থেকে একই ঘটনা জানা যায়। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে ঘটনাটি মণিপুরের নয়, অর্থাৎ দাবিটি মিথ্যা। ভারতীয় তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টলি-ও সম্প্রতি এ বিষয়ক একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রসঙ্গত, মণিপুরে নেজাহোই লুংডিম ও লিমখোলাল মেটে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোমবার ইম্ফলে বিক্ষোভ করেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। মণিপুর থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর অপসারণ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের সুরক্ষার দাবিতে থাউবাল ও ইম্ফলসহ বিভিন্ন অংশে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন। এর জেরে গোটা রাজ্যে ব্যাপক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।