তৌহিদুল ইসলাম রাসো
ড. ইউনূসকে নিয়ে ছড়ানো মিথ্যা তথ্যে ধর্মীয় রঙ
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
চলতি বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গিয়ে দেশত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়ে ৮ আগস্ট অন্তর্বতীকালীন সরকার ঘোষণা করেন। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে জড়িয়ে একাধিক অপতথ্য ছড়িয়েছে ফেসবুকে। এসব অপতথ্যের সঙ্গে ইউনূসকে জড়িয়ে ধর্মীয় রঙে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর একাধিক ঘটনা খুঁজে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
ড. ইউনূসকে জড়িয়ে এমন অপতথ্যের সর্বশেষটি ছিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ছবি সরিয়ে আরবিতে কালিমা তাইয়্যেবা যুক্ত করা নিয়ে। একাধিক ফেসবুক পোস্টে (১, ২, ৩) কার্যালয়ের একটি ছবি শেয়ার করে প্রায় একই ক্যাপশনে দাবি করে লেখা হয়, “আলহামদুলিল্লাহ! অনেকটা পরিবর্তন, আগে মাথার উপরে ফটো ও ছবি ছিল, বর্তমানে মাথার উপরে কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লেখা।” উক্ত পোস্টের ক্যাপশনে এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “ইনশাআল্লাহ সবার সকলের ভেতর ইসলামী মনোভাব আছে।” আরেক পোস্টে এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর স্বপ্ন গুলো মনে হয় বাস্তবাহীত হচ্ছে।”
তবে যাচাইয়ে দেখা যায় দাবিটি ভুয়া। অনলাইনে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে একই ছবি সম্বলিত একাধিক সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে ব্যবহৃত একই কার্যালয়ের একই জায়গায় আরবিতে কালিমা তাইয়্যেবার সেই আয়াতই লেখা ছিল। কার্যালয়ের ছবি ব্যবহার করে সবচেয়ে পুরোনো যে প্রতিবেদন পাওয়া যায় সেটি দ্য ডেইলি সানের। ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বরের সেই প্রতিবেদনটি ছিল ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতি-২০১৮’ এর খসড়ার অনুমোদন দেওয়া নিয়ে। এছাড়া বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনে এবং প্রথম আলোর চলতি বছরের মে মাসের এক প্রতিবেদনে কার্যালয়ের ছবিতে কালিমা তাইয়্যেবা লেখা আয়াত দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, প্রায় ৬ বছর আগের সংবাদ প্রতিবেদনেও কার্যালয়ের উক্ত জায়গায় কোনো ছবি ছিল না। তখনও আরবিতে কালিমা তাইয়্যেবা লেখা ছিল, যা এখনও আছে। তাই সেখানে কালিমা নতুন করে লেখার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
প্রধান উপদেষ্টা হবার পর থেকে ড. ইউনূসকে নিয়ে আরও কয়েকটি ধর্মীয় অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। গত ২০ আগস্ট ফেসবুকে যমুনা টিভির নকল ফটোকার্ড পোস্ট করে বলা হয় ১ সেপ্টেম্বর থেকে সকল মসজিদ মাদ্রাসার কারেন্ট বিল ফ্রি করে দিয়েছেন ড. ইউনূস। তবে এই দাবি ও গণমাধ্যমের গ্রাফিক কার্ডটি ভুয়া বলে সে সময় ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের একটি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান।
একই সময়ে আরেকটি ভিন্ন দাবি ছড়ায় ফেসবুকে। এই দাবিতে বলা হয় এখন থেকে বাংলাদেশের কোরআন মাহফিল করতে কোন প্রশাসন বা কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তবে উক্ত মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সূত্রের উল্লেখ করা হয়নি পোস্টে। পরবর্তীতে এই মন্তব্যটিকে ভুয়া বলে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য এর আগে অনুমতি না নেওয়ায় প্রশাসনের মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশে।
চলতি মাসেও ড. ইউনূসকে নিয়ে আরেকটি ধর্মীয় অপতথ্য ছড়ানো হয়। গণমাধ্যমের গ্রাফিক কার্ড নকল করার পাশাপাশি একাধিক ফেসবুক পোস্টে প্রধান উপদেষ্টার উক্তি দাবি করে প্রচার করা হয় যে তিনি আলেমদের ভালোবাসেন এবং তাদের সঙ্গে কাজ করতে চান। পরে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দাবিটি ভুয়া। এসব ফটোকার্ড যে গণমাধ্যমের নামে প্রচার করা হয়েছে তারা আদতে এমন কোনো ফটোকার্ড প্রচার করেননি এবং ড. ইউনূসের এমন কোনো বক্তব্য গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও পাওয়া যায় নি।
ধর্মীয় রঙে ছাড়াও ড. ইউনূসকে জড়িয়ে অপতথ্য ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এদের মধ্যে একটি ছিল আর্থিক অনুদান সংক্রান্ত। ফেসবুকে একটি লিঙ্ক দাবি করে শেয়ার করা হয় দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল নাগরিক ও ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ৫০০০ টাকা অনুদান দিচ্ছেন তিনি। তবে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিষয়টি ভিত্তিহীন।
এছাড়া আরও কয়েকটি ভুয়া দাবির মধ্যে ছিল ড. ইউনূস এদেশে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করছেন অথবা বলেছেন এখন থেকে চেয়ারম্যান হতে হলে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে হবে। তবে এই দাবিগুলোকে ভুয়া প্রমাণ করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন (১, ২) প্রকাশ করেছে দেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।