ফাতেমা তাবাসুম
ছবির এই নারী অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়া নন
ফাতেমা তাবাসুম
সম্প্রতি, ঢাকার আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়ার পদত্যাগের দাবিতে মাঠে নেমে শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষকে রশি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখে– এমন দাবিতে একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। একাধিক পোস্টে (১, ২, ৩, ৪) একই দাবিতে ছবিটি শেয়ার হতে দেখা যায়। তবে ডিসমিসল্যাব ছবি ও তথ্য যাচাইয়ে জানতে পেরেছে, ছবিটি আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়া কিংবা অন্য কোনো শিক্ষিকার নয়। তিনি নিজেই বিষয়টি ডিসমিসল্যাবকে নিশ্চিত করেছেন।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা একজন নারীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে- এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি ভাইরাল হতে দেখা গিয়েছে। ফেসবুকে একাধিক পোস্টে ছবিটি ব্যবহার করে দাবি করা হয়, “ঢাকার আজিমপুর গভঃমেন্ট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়ার পদত্যাগের দাবিতে মাঠে নেমেছিল কতিপয় শিক্ষার্থী…. ছবিতে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা সেই শিক্ষিকাকে রশি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে! একপর্যায় সেনাবাহিনী এসে তাকে ছাত্রীদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়…..।” দাবির সঙ্গে পোস্টটিতে “সেভ বাংলাদেশি হিন্দুস” হ্যাশট্যাগটিও ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। এছাড়া আরেকটি প্রোফাইল থেকে ছবিটি শেয়ার করা হলে অনেকেই সেটিকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার বলে অভিযোগ করেন। এমনই একটি পোস্টে একজন ব্যবহারকারীকে মন্তব্য করতে দেখা যায়, “এই পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের জোর পূর্বক ১০০ অধিক পদত্যাগ করিয়েছে।” একই পোস্টে আরেকজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “দল বেঁধে সব মাইনোরিটি শিক্ষকদের স্কুল, কলেজ থেকে জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে। দেশটাতে খুব সুন্দর ষড়যন্ত্র চলছে সবখানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করার।”
ডিসমিসল্যাব পোস্টের কিওয়ার্ড ধরে খোঁজ করলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়ার পরিচয় ও ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। এই ছবির সঙ্গে ভাইরাল হওয়া ছবিটিতে থাকা নারীর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে ডিসমিসল্যাব সরাসরি অধ্যক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করে। তিনি জানান, এমন কোনো ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেনি। তিনি বলেন, “আমাকে কেউ গাছের সাথে বেঁধে রাখেনি।” অধ্যক্ষ বড়ুয়া আরো জানান গত ১৮ আগস্ট আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে তিনি নিজ অফিসে বসে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। তিনি নিশ্চিত করেন প্রতিষ্ঠানে সেদিন (১৮ আগস্ট) তিনি যতক্ষণ ছিলেন তার সঙ্গে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরও জানান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রতিষ্ঠানে তার জন্য নির্ধারিত কক্ষেই অবস্থান করেছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে তিনি অফিস ত্যাগ করেন এবং এরপর তিনি আর সেখানে ফিরে যাননি।
কিওয়ার্ড সার্চে মূলধারার গণমাধ্যম আজকের পত্রিকায় ১৯ আগস্ট “শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধামকি, আজিমপুরে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে”– শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে ভাইরাল ছবির ঘটনাটির আরও কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের দাবি অনুসারে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা নারী ছিলেন একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
একই ঘটনা উঠে আসে ১৮ আগস্ট এটিএন নিউজের ইউটিউব চ্যানেলে, “শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ নেত্রীদের হামলা, অতঃপর…!” শিরোনামের একটি ভিডিও প্রতিবেদনে। সেখানে এটিএন নিউজকে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী ও দুইজন অভিভাবকের বয়ান থেকে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ দাবি নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিল। সেসময় কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিচয়ে কিছু নারী তাদের মাঝে এসে অরাজকতার সৃষ্টি করলে শিক্ষার্থীরা তাদের ঘিরে ফেলে এবং প্রতিবাদ জানায়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আটকে রেখে মারধর ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগও তোলেন।
প্রতিবেদনের এক অংশে কালো পোশাক পরিহিত গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা সেই নারীকেও দেখা যায়। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি নিজেকে “প্রাক্তন শিক্ষার্থী” হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানান, তিনি জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে এসেছেন। এসময় সেই নারীর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ তুলে একজন শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, “ওনার কোনো পরিচয় পত্র নাই, ওনাকে ভাড়া করে আনা হয়েছে।” এটিএন নিউজের প্রতিবেদনের শিরোনামে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত সেই নারীদের “ছাত্রলীগ নেত্রী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনগুলোর কোথাও এই নারীকে কলেজের অধ্যক্ষ বা শিক্ষক বলে দাবি করা হয়নি।
অর্থাৎ, গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা ঐ নারী গীতাঞ্জলি বড়ুয়া নন। আজকের পত্রিকা ও এটিএন নিউজ গণমাধ্যম দুটো হেনস্তার শিকার ঐ নারীকে যথাক্রমে প্রতিষ্ঠানটির “প্রাক্তন শিক্ষার্থী” ও “ছাত্রলীগ নেত্রী” হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইতিপূর্বেও সামাজিক মাধ্যম টুইটারে (বর্তমানে এক্স) সাবেক সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড় ও বেঁধে রাখার বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দাবিতে ছড়িয়ে পড়লে, ডিসমিসল্যাব সেসকল ভিডিও যাচাইপূর্বক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।