ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে যেসব অপতথ্য ছড়িয়েছে টুইটারে
This article is more than 1 month old

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে যেসব অপতথ্য ছড়িয়েছে টুইটারে

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকার দলীয় নেতাদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কার্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-দোকান-উপাসনালয়েও হামলা চালানো হয়। তবে সামাজিক মাধ্যম, এক্সে (সাবেক টুইটার) এমন অনেক ছবি-ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে, যেগুলোর সঙ্গে এমন সাম্প্রদায়িক হামলার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব পোস্টের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে সেভ বাংলাদেশি হিন্দুজ, হিন্দুজ আর নট সেফ ইন বাংলাদেশ, অল আইজ অন বাংলাদেশি হিন্দুজ ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ। এই প্রতিবেদনে এমন কয়েকটি ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছে ডিসমিসল্যাব। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা-নির্যাতনের এমন আরও কিছু ভুয়া দাবি সম্বলিত পোস্ট নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এই তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান।

ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার ভিডিওটি হিন্দু হোস্টেলের নয়

৭ আগস্ট, একাধিক এক্স অ্যাকাউন্ট (, , ) থেকে একটি ভিডিও পোস্ট দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, ঢাকার একটি হিন্দু হোস্টেলে আক্রমণ চালিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। প্রান বাঁচাতে শিক্ষার্থীরা কার্নিশে ঝুলে আছেন। 

কিন্তু যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওটি পুরোনো। ঘটনাটি ঘটেছিল গত ১৬ জুলাই, চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুর এলাকায়। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন (, , ) থেকে জানা যায়, সেদিন সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা এই ভবনটির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর ওই ভবনের ছাদে উঠে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগ কর্মীদের ছাদ থেকে ফেলে দেন। অনেকে ভবনটির পানির পাইপ ও কার্নিশ বেয়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা ছাদ থেকে তাদের দিকে পাথর ছুড়তে থাকেন এবং এসময় কয়েকজন নিচে পড়ে যান। এ ঘটনায় পরবর্তীতে একটি মামলাও হয়েছিল। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এর সঙ্গে ঢাকার কোনো হিন্দু হোস্টেলের সংশ্লিষ্টতা নেই। 

গণপিটুনির শিকার ব্যক্তি চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান

বেশ কয়েকটি এক্স অ্যাকাউন্ট (, ,, ) থেকে উত্তেজিত জনতার গণপিটুনির শিকার এক ব্যক্তির ভিডিও শেয়ার করে তাকে হিন্দু বলে দাবি করা হচ্ছে। যাচাইয়ে দেখা গেছে ভিডিওটি চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানের।

অ্যামি মেক নামের নিউইয়র্ক সিটি ভিত্তিক ভেরিফায়েড একটি অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি পোস্ট করে লেখা হয়, “বাংলাদেশের ভয়াবহ বাস্তবতা: হিন্দুদের গণহত্যা। বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত হিন্দু আমাকে আইএসআইএস-স্তরের ভিডিও পাঠাচ্ছে, আমি আতঙ্কিত। নৃশংসতা এতটাই চরম যে আমি তাদের বেশিরভাগ পোস্টও করতে পারি না।” আঁচল যাদব নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়, “শান্তি প্রতিষ্ঠাকারীরা হিন্দুদের নির্যাতন ও হত্যা করছে।” তবে আঁচল যাদব অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা ভিডিওর মন্তব্যের ঘরে এক ব্যবহারকারী সেলিম খান ও তার ছেলে শান্ত খানের নিহত হওয়ার সংবাদ পোস্ট করে লেখেন, “ইনি চাঁদপুরের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সেলিম খান। তার ছেলেকেও হত্যা করা হয়েছে।” 

সুমিত চৌধুরী নামে ভারতীয় একজন সাংবাদিকও ৬ আগস্ট মধ্যরাতে ভিডিওটি এক্স অ্যাকাউন্টে শেয়ার করে লেখেন, “চাঁদপুরের বালু খেকো সেলিম চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগের নেতা বাংলাদেশের উত্তেজিত জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।” চাঁদপুরের স্থানীয় গণমাধ্যম চাঁদপুর টাইমসের বার্তা সম্পাদক আব্দুস সালামও ডিসমিসল্যাবকে নিশ্চিত করেন যে ভিডিওটি চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম খান।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ৫ তারিখ সন্ধ্যার পর একটি মোটরসাইকেলে করে গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন সেলিম খান ও তাঁর ছেলে শান্ত খান। পথে বাগড়াবাজার এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতার চোখে ধরা পড়েন তাঁরা। এ সময় নিজের পিস্তল থেকে কয়েক রাউন্ড গুলিও করেন। এতে জনতার রোষানলে পড়ে গণপিটুনির শিকার হন তাঁরা। এতে দুজনই নিহত হন। এ ঘটনার পর থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত তাঁদের মরদেহ ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিল।

পিলারের সঙ্গে নারীদের বেঁধে রাখা ভিডিওটি হিন্দু নির্যাতনের নয়

একটি ভবনের পিলারের সঙ্গে দুই নারীকে বেঁধে রাখা হচ্ছে– এমন ভিডিও আপলোড করে এক্সের একাধিক পোস্টে (, , ) দাবি করা হয়েছে, “মুসলিম নারী হিন্দু নারীদের বেঁধে রেখেছে”। যদিও ভিডিওটির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-হিংসার কোনো সম্পর্ক নেই।

যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওর ঘটনাটি ঘটে গত ১৭ জুলাই, ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন (, ) থেকে জানা যায়, পিলারের সঙ্গে বেঁধে রাখা দুই শিক্ষার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মী। ফেসবুকেও এ সংক্রান্ত অনেক ভিডিও (, , ) দেখতে পাওয়া যায়। এই ঘটনাটিকেই ধর্মীয় আঙ্গিক দিয়ে হিন্দু ছাত্রীদের নির্যাতন করা হচ্ছে– এমন ভাষ্য তৈরি করা হয়েছে। 

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৭ জুলাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দখলে থাকা রুমগুলোতে হামলা-ভাঙচুর (, , ) চালানো হয়। 

অগ্নিসংযোগ করা রেস্টুরেন্টকে মন্দির দাবি

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়, তার মধ্যে ছিল সাতক্ষীরার একটি রেস্টুরেন্ট, যার নাম রাজ প্রাসাদ কফি শপ ও রেস্টুরেন্ট। এক্স-এ এই ভবনটিতে অগ্নিসংযোগের একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয় যে, মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেস্টুরেন্টটির মালিক ছিলেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি কাজী আসাদুজ্জামান শাহজাদার। এই ভিডিওটি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দিয়ে ভুল তথ্য প্রচার

ভয়েস অব বাংলাদেশি হিন্দুজ নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্টের পোস্টে একটি সংবাদের স্ক্রিনশট দিয়ে ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। ৬ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল, “সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগ নেতার ৫ স্বজনসহ নিহত ১৪”। এক্সের পোস্টটিতে দাবি করা হয়েছে যে, এই নিহত ১৪ ব্যক্তির মধ্যে ৭ জনই ছিলেন হিন্দু। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় জানিয়ে লেখা হয়েছে, “নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কল্যাণপুর গ্রামের বাসিন্দা জাকির হোসেন, তাঁর ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন, ভাইপো সজিব হোসেন, ভাগনে আশিকুর রহমান, স্বজন সাকের আলী ও গাড়িচালক শাহিন হোসেন। এ ছাড়া আশাশুনি থানার কল্যাণপুর গ্রামের আদম আলী (২৮), কোলা গ্রামের আনাজ বিল্লাহ (১৭) ও কুড়িকাউনিয়া গ্রামের আনাজ আলী (১৮), সদর উপজেলার বৈকারি গ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী আসাফুর রহমান (৪০), মৃগাডাঙ্গা গ্রামের তৌহিদ ইসলাম (৩০), সাইফুল ইসলাম (২৫), বিএনপির কর্মী জাহিদ হোসেন (২৮) ও ফারুক হোসেন (৩৫) নিহত হয়েছেন।” 

এক্সের পোস্টটিতে নিহত হিসেবে যে ৭ হিন্দু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব নামও দেখতে পাওয়া যায় প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে। তবে তাঁরা কেউই নিহত হননি। প্রতিবেদনটিতে ৩১ জন এমন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যালয়ে ভাঙচুর, লুটপাট বা অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সেই ৩১ জন ব্যক্তির ভেতরে পাওয়া যায় এই সাত হিন্দু ব্যক্তির নাম। 

পরিচয় নিশ্চিত নয়, কিন্তু দাবি করা হচ্ছে হিন্দু

ওভারব্রিজ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় দুইটি লাশের দৃশ্য থাকা ভিডিও পোস্ট (, ) করে দাবি করা হয়, নিহত দুই ব্যক্তির নাম রাজু দাস ও ব্যারাম গরিল। ভিডিওটি ভালোমতো পর্যবেক্ষণে দেখা যায় পেছনে একটি ভবনে ‘বাইপাইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ’ লেখা। বাইপাইল এলাকাটি ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার একটি জায়গা। 

গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ যাচাই করতে গিয়ে ডেইলি স্টার ও দৈনিক ইনকিলাবের দুটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদন অনুসারে, ৫ আগস্ট সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দিনভর সংঘর্ষের ঘটনায় ওই দুইজন নিহত হন। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। ডেইলি স্টার লিখেছে, “ঢাকার আশুলিয়া থানাধীন বাইপাইল এলাকায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের ওভারব্রিজে কাল সারারাত ধরে ঝুলছিল দুটি মরদেহ। আজ মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকালে মরদেহ দুটি নামানো হয়। মরদেহ দুটি পুলিশ সদস্যদের হতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা।” দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিবেদন অনুসারে, “মঙ্গলবার সকালে আশুলিয়ার বাইপাইলের কাছে ফুট অভারব্রিজের দুই জনের লাশ ব্রিজের রেলিংএর সাথে উল্টো করে ঝুলানো দেখতে পেয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।”

অর্থাৎ, ভিডিও ও ছবিগুলোর ঢাকার আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার। গত ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার পর পুলিশ সন্দেহে ওই ব্যক্তিদের হত্যার পর তাদের লাশ ব্রিজ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ঝুলিয়ে রাখা লাশগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।

আরো কিছু লেখা