তামারা ইয়াসমীন তমা
আন্দোলনে গুলি: গুজবে পুরোনো ছবি, অস্ত্রধারীর মিথ্যা পরিচয়
তামারা ইয়াসমীন তমা
চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের একাধিক ছবি, গত ২ আগস্ট থেকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়াতে থাকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলটির সমর্থকদের বিভিন্ন পেইজ ও প্রোফাইল থেকে দাবি করা হয়, এসব ছবির অস্ত্রধারীরা আন্দোলনকারী বা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা। এরকম তিনটি ছবি যাচাই করে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায়, এদের মধ্যে দুটি ছবি পুরোনো, অর্থাৎ চলমান আন্দোলনের নয়। আর একটি ছবির অস্ত্রধারী উল্টো ক্ষমতাসীন দলের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে গণমাধ্যমের খবর বেরিয়েছে।
১। ছবিটি পুরোনো, অস্ত্রধারী যুবলীগের
গত ২ আগস্ট আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে তিনটি ছবিসহ একটি গ্রাফিক্স কার্ড প্রকাশিত হয়। একটি ছবিতে শার্ট, নীল জিন্স এবং লাল হেলমেট মাথায় একজনকে গুলি চালাতে দেখা যায়। পোস্টে দাবি করা হয়, পুলিশ একজন আহত কিশোরকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে এবং ছেলেটি শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুক আহমেদের গুলিতে আহত হয়েছে। একই দাবিতে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট (১, ২) পাওয়া গেছে। পোস্টগুলোতে বলা হয়, “আন্দোলন এখন #বিএনপিজামাত এর। তারা আপনার সন্তানকে #মেরে ফেলে তার লাশের উপর দাড়িয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়।”
যাচাইয়ে দেখা গেছে, ছবিটি সাম্প্রতিক আন্দোলনের নয়, বরং ২০২৩ সালের। ঐ বছরের ১৭ আগস্ট, প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে অস্ত্রধারী ব্যক্তির ছবিটি পাওয়া যায়। ছবির ক্যাপশনে তাকে কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের যুবলীগ সভাপতি বেলাল উদ্দিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, সেদিন মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত ও প্রয়াত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজাকে কেন্দ্র করে সেখানে একটি সংঘর্ষ হয়েছিল। দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রতিবেদনেও বলা হয়, অস্ত্র হাতে ওই যুবকের নাম বেলাল উদ্দিন। অর্থাৎ, ছবিটি সিলেটের সাম্প্রতিক আন্দোলনের নয় এবং পোস্টে অস্ত্রধারীর যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা-ও মিথ্যা।
২। অস্ত্রধারী ব্যক্তিটি আন্দোলনকারীদের কেউ নন
একই দিন সামাজিক মাধ্যমে একই ধরনের আরেকটি পোস্ট ছড়ায়। সেই পোস্টের ছবিতে হালকা ফিরোজা পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তিকে অস্ত্র হাতে দৌঁড়াতে দেখা যায়। ফেসবুকে ছড়ানো বিভিন্ন পোস্টে (১, ২) ছবিটিকে কখনো ঢাকার উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের, আবার কখনো লক্ষ্মীপুর চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বলে দাবি করা হয়। একটি পোস্টে ইঙ্গিত করা হয় অস্ত্রধারী ব্যক্তিটি আন্দোলনকারীদের একজন, আবার অন্য দুটি পোস্টে বলা হয় সেই অস্ত্রধারী মূলত শিবিরের।
যাচাইয়ে দেখা যায়, ঘটনাটি ঘটেছে ২ আগস্ট, লক্ষ্মীপুরে। ছবিটি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের সময়কার। খবরে বলা হয়, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করা ব্যক্তিটির নাম মো. রাসেল এবং তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাউদ্দিন ওরফে টিপুর গাড়িচালক।
৩। ছবিটি পুরোনো, অন্তত ছয় বছর আগের
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড পেজ থেকে পোস্ট করা একটি গ্রাফিক্স কার্ডে কয়েকজন মোটর সাইকেল আরোহীর ছবি দিয়ে দাবি করা হয় তারা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের কর্মী, যারা গত ২ আগস্ট (শুক্রবার) জুমার নামাজের পর মাঠে নেমেছিল। ক্যাপশনে লেখা হয়, “পবিত্র জুম্মার নামাজ শেষ হওয়ার পর পবিত্র নগরী সিলেটকে অশান্ত করার জন্য মাঠে নেমেছিলো দেশবিরোধী জঙ্গি #জামায়াত শিবির। দেশীয় অস্ত্র হাতে সাস্ট ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক পিয়াল হাসান এবং পাঞ্জাবি পরিহিত সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি শরীফ মাহমুদ। প্রিয় অভিভাবক, আপনার সন্তানঅকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তার লাশের উপর দাড়িয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। এই দেশ #জঙ্গিসংগঠনের অভয়ারণ্যে পরিণত হবেনা।”
তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, ছবিটি অন্তত ৬ বছরের পুরোনো এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। রিভার্স ইমেজ সার্চে সিলেট টুডে ২৪ নামের সিলেটের স্থানীয় একটি অনলাইন পত্রিকায় ছবিটি পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের ২১ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে সাবেক যুবলীগ নেতা আব্দুল হান্নানের মালিকানাধীন মৌরসী রেস্টুরেন্টে হামলার ফুটেজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। খবর অনুসারে, শিবির কর্মীরা ওই যুবলীগ নেতার রেস্টুরেন্টে হামলা চালান বলে অভিযোগ উঠে। সামাজিক মাধ্যমেও ২০১৮ সালে ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও জামায়াত নেতা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট এহছানুল মাহবুব জুবায়েরের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে রেস্টুরেন্টে হামলার অভিযোগ আনা হয়।
কোটা সংস্কারের দাবিতে বাংলাদেশে আন্দোলন শুরু হয় গত ১ জুলাই থেকে। ১৫ জুলাই থেকে এই আন্দোলন ধীরে ধীরে সহিংস হয়ে উঠতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় আন্দোলনকারীরা। বেসরকারি হিসাবে আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ নিহতের সংখ্যা দুইশর অধিক ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব সংঘর্ষে বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশের নিযুক্ত স্পেনের রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েল মারিয়া সিস্তিয়াগা ওচোয়া ডি চিনচেত্রু-র সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন “কোটা আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ করে”। সর্বশেষ, ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে।