ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
অপতথ্য সামাজিক মাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলের অপরিহার্য অংশ, বলছে গবেষণা
This article is more than 10 months old

অপতথ্য সামাজিক মাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলের অপরিহার্য অংশ, বলছে গবেষণা

ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক

প্রতারণামূলক অনলাইন কনটেন্ট একটি বড় ব্যবসা। বর্তমানে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজারমূল্য ৬২৫ বিলিয়ন ইউরো। এবং তাদের ব্যবসায়িক মডেল খুব সহজ-সাধারণ: বেশি ক্লিক, ভিউ বা সম্পৃক্ততা মানেই বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে বেশি অর্থ পাওয়া। উস্কানিমূলক বা তাক লাগানো কনটেন্ট – তা সত্য হোক বা না হোক – দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি সহজ উপায়। যার মানে বিজ্ঞাপনদাতারা হয়তো তাদের অর্থ খরচ করতে পারেন ভুয়া খবরবিদ্বেষমূলক বক্তব্যের পেছনেও।

এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো জানে যে তারা অপতথ্যের বিস্তার থেকে লাভবান হয়। আর বিজ্ঞাপনদাতারা যেন দেখেও দেখে না

অপতথ্য ছড়ানো হয় রাজনৈতিক, সামরিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সমাজকে বিভ্রান্ত, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও মেরুকরণ করার জন্য। এটি করা হয় কৌশলগতভাবে প্রতারণামূলক কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব অপতথ্য ছড়ানোর উপায়গুলোর মধ্যে আছে বট, ডিপফেক, ভুয়া খবর ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।

এখন পর্যন্ত অপতথ্য নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণা আলোকপাত করেছে কীভাবে জাতীয় স্বার্থে এবং কর্তৃত্ববাদী নেতারা এই ব্যবস্থাটি কাজে লাগায়– তার ওপর। তবে আমার গবেষণাটি দেখিয়েছে, অপতথ্য প্রকৃতপক্ষে এই বাজার ব্যবস্থার একটি সম্ভাব্য ও অনুমানযোগ্য ফলাফল। কোনো অপ্রত্যাশিত পরিণতি নয়।

একটি ব্যবসায়িক মডেল যা বেশি সম্পৃক্ততাকে পুরস্কৃত করে

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো তথ্য প্রকাশের জন্য ডিজাইন করা হয়নি, বরং করা হয়েছে বিনোদনের জন্য। এগুলো ডিজাইন করা হয়েছে মজার মজার সব বিড়ালের ভিডিও-র মতো জিনিস শনাক্ত করার জন্য এবং সেসব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, যারা এগুলো শেয়ার করবে। তবে মার্কেটিং গবেষকেরা দেখেছেন যে, যেসব কনটেন্টে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী ইতিবাচক আবেগ কিংবা রাগ ও উদ্বেগের মতো নেতিবাচক আবেগ তৈরির মতো উপাদান থাকে, সেগুলোই ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্ল্যাটফর্মগুলো এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে এবং এগুলোর ওপর ভিত্তি করে তাদের ব্যবসায়িক মডেল গড়ে তুলেছে।

সামাজিক মাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেল এভাবে কাজ করে: প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের বিনামূল্যে “ইনফোটেইনমেন্ট” (তথ্য এবং বিনোদন) প্রদান করে এবং আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে থাকে। আমরা যখন সেখানে কোনো কনটেন্ট দেখি, তখন প্ল্যাটফর্মগুলো সেসব ডেটা সংগ্রহ করে এবং সেগুলো দিয়ে সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করে। এসব তথ্য পরবর্তীতে ব্যবহার করা হয় বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য। বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপনী প্রচারণা চালানোর লক্ষ্যে এসব বিশ্লেষণের জন্য অর্থ প্রদান করে।

বেশিরভাগ প্ল্যাটফর্মেই অনলাইন সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য আর্থিক প্রণোদনা থাকে। যার অর্থ যেকোনো কনটেন্ট – সেটি সত্য হোক বা না হোক – বেশি ক্লিক, লাইক ও কমেন্ট পেলে সেটি মূল্যবান বিবেচনা করা হবে। যার ফলে বিতর্কিত কনটেন্ট শেয়ার করেও কোনো ইনফ্লুয়েন্সার ধনী হয়ে উঠতে পারেন এবং অন্য আরও অনেকে এই একই কৌশল অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। অতএব, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, অনেক কনটেন্ট নির্মাতা বৈরিতামূলক, সরলীকৃত এবং আবেগপূর্ণ বিষয়বস্তু প্রকাশ করেন যেখানে থাকে আমরা-বনাম-তারা ভাষ্য। 

সামাজিক উদ্বেগ এবং গোষ্ঠীগত বিভাজন উসকে দেওয়ার মাধ্যমেও ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো প্রচার হয়

ডিজিটাল মার্কেটিং এবং অপতথ্য 

ডিজিটাল মার্কেটিং একটি বাণিজ্যিক চর্চা, যার মাধ্যমে সংস্থাগুলো ইন্টারনেটে নিজেদের মূল্যমান তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে সার্চ অপটিমাইজেশন, কনটেন্ট বিপণন, ইনফ্লুয়েন্সার, পে-পার-ক্লিক বিজ্ঞাপন, অ্যাফিলিয়েট প্রোগ্রাম এবং সাধারণ বিজ্ঞাপন। ব্র্যান্ডগুলো অ্যাড টেক নামে পরিচিত ডিজিটাল বিপণন সংস্থা নিয়োগ করে, যারা এমন সফটওয়্যার পরিচালনা করে, যেগুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞাপনগুলো ইন্টারনেটে আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে থাকে

অ্যাড টেক ফার্মগুলো কোনো জবাবদিহি বা তদারকি ছাড়াই কাজ করে। তাই যখন একটি ব্র্যান্ড একটি অ্যাড টেক ফার্মকে তাদের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য অর্থ প্রদান করে, তখন তারা তাদের দায়িত্বও আউটসোর্স করে। একটি ব্র্যান্ড তাই অজান্তেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মতো বড় বৈশ্বিক ঘটনা সম্পর্কে অপতথ্যের পেছনে অর্থায়ন করতে পারে। তবে প্রমাণ উপস্থাপনের পরও ব্র্যান্ডগুলো নীরব থাকে।

ইন্ফ্লুয়েন্সাররা এই সাংঘাতিক ডিজিটাল বাজারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞাপনের অর্থ পাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে তারা যেকোনো মূল্যে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করে। এজন্য তারা এমন কনটেন্টও প্রচার করে, যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলো দূর্বল হতে পারে। বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারের জন্য একজন ইনফ্লুয়েন্সারকে ডিমনিটাইজ বা নিষিদ্ধ করা হলেও এর ফলে সামগ্রিকভাবে প্ল্যাটফর্মে কোনো প্রভাব পড়ে না কারণ তারপরেও প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের বিজ্ঞাপনী মুনাফা ধরে রাখতে পারে

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর গণতান্ত্রিক শাসন

বেশিরভাগ ব্র্যান্ড বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং বট ফার্মের সঙ্গে যুক্ত হতে না চাইলেও যুক্ত হয়ে পড়ে। প্রযুক্তিগতভাবে জটিল এই বাজারে মুখ ঘুরিয়ে থাকা সহজ, কিন্তু বিপণনকারীদের একটি দায়িত্বও আছে। ব্র্যান্ডগুলি নীরব থাকার মাধ্যমে সেই দায়িত্বে অবহেলা করে এবং পরোক্ষভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে।

নীতিনির্ধারক ও অ্যাক্টিভিস্টরা অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনোযোগ দেওয়া হয় কনটেন্ট মডারেশন এবং তথ্য যাচাইয়ের উপর। কিন্তু ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার সংস্কারের দিকে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।

অপতথ্য থেকে লাভবান হয়– এমন একটি বাজার সংস্কারের জন্য অবশ্যই কাজ করা উচিৎ প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাড টেক ফার্মগুলোর। যদিও তারা এটি করতে অনিচ্ছুক বলেই প্রতীয়মান হয়। 

ব্র্যান্ড ম্যানেজারেরা প্ল্যাটফর্মগুলোকে জবাবদিহি করতে তাদের বাজেট ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ করে যদি তারা বড় সংখ্যায় কাজ করে। যেমনটি সম্প্রতি দেখা গেছে এক্স (পূর্বে টুইটার) বিজ্ঞাপন বয়কট করার মাধ্যমে। এটি করা হয়েছিল ইলন মাস্কের ইহুদি-বিদ্বেষী বক্তব্যের পর। অন্য সব কিছু ব্যর্থ হলে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মুনাফার জন্য আমাদের গণতন্ত্রকে মূল্য দিতে না হয়।


কার্লোস ডিয়াজ রুইজ-এর এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশন-এ। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তৌহিদুল ইসলাম রাসো।

আরো কিছু লেখা