আহমেদ ইয়াসীর আবরার
রিজভীর নামে ছড়ানো ভুয়া বক্তব্যের সমন্বিত প্রচারণা
আহমেদ ইয়াসীর আবরার
সম্প্রতি ফেসবুকে কিছু পেজ ও গ্রুপে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নামে একটি বক্তব্য গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ছড়ানো হয়। কার্ডটিতে, মনোনয়ন বাণিজ্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে রিজভীর একটি মন্তব্য রয়েছে। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, রুহুল কবির রিজভী এধরনের বক্তব্য দেননি। ফেসবুকে এই ভুয়া বক্তব্য অন্তত ১৯টি পেজ থেকে ছড়ানো হয়। এদের মধ্যে ছয়টি পেজ থেকে আগেও ভুয়া তথ্য প্রচারিত হতে দেখা গেছে, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান যাচাই করেছে।
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দেড়টার মধ্যে ১৯টি পেজ কার্ডটি পোস্ট করে। কার্ডটিতে রুহুল কবির রিজভীর বরাতে বলা হচ্ছে, “তারেক জিয়ার মনোনয়ন বাণিজ্য নস্যাৎ করতেই বিএনপির দলত্যাগী নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।” ১৯টির মধ্যে ১৮টি পেজে, কার্ডের সঙ্গে যে টেক্সট ক্যাপশন ছিল তাতে হুবহু একই ভাষা, একই হ্যাশট্যাগ ও একই রকমের তারকা চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, রুহুল কবির রিজভী এধরনের কোনো বক্তব্য দেননি। অনলাইনে সার্চ করে রুহুল কবির রিজভীর এ ধরনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গ্রাফিক কার্ডে রিজভীর যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি ৩০ নভেম্বর বিএনপির অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত একটি লাইভ ভিডিও থেকে নেওয়া। সেই ভিডিওতে এমন কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এই বক্তব্যটি বানোয়াট। বিভ্রান্তি তৈরি করতে দুষ্ট চক্রের তৈরি করা বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে”।
ভুয়া উদ্ধৃতির গ্রাফিক কার্ডটি সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে পোস্ট করে ১২টি পেজ। সবগুলো গ্রাফিক কার্ডেই “হ্যাশ ট্যাগ বিএনপি”-র লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। তবে হ্যাশ ট্যাগ বিএনপি” নামের পেজটি নিজে কার্ডটি পোস্ট করে সন্ধ্যা ৬.৩০ টায়। তার আধ ঘন্টা আগেই গ্রাফিক কার্ডটি পোস্ট করে বিএনপি নিউজ নামের আরেক পেজ। একই সময়ে ভুয়া উদ্ধৃতিটি ১৮টি ফেসবুক গ্রুপেও পোস্ট করা হয় ।
রাত ৮:০০ টা থেকে ৮:১০-এর মধ্যে, সেই ভুয়া উদ্ধৃতি সম্বলিত ভিন্ন ডিজাইনের আরেকটি গ্রাফিক কার্ড, চারটি পেজ থেকে পোস্ট করা হয়।
গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে যে ১২টি পেজ থেকে এই ভুয়া উদ্ধৃতি পোস্ট করা হয়– সেগুলোর মধ্যে অন্তত ৫টির নাম দেখে আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি সমর্থক পেজ বলে মনে হতে পারে: খালেদা জিয়ার অনুসারী, খালেদা জিয়ার সৈনিক, মেজর জিয়া অমর হোক, তারেক রহমান আপডেট, এবং তারেক জিয়া সাইবার ফোর্স। কিন্তু পোস্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, পেজগুলো মূলত বিএনপি বা দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট শেয়ার করে।
“হ্যাশ ট্যাগ বিএনপি” নামে যে পেজটির লোগো গ্রাফিক কার্ডটিতে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটির বিবরণে বলা হয়েছে, “তারা বিএনপির ব্র্যাণ্ড অ্যাম্ব্যাসেডর।” পেজটিতে একটি ওয়েবসাইটের ইউআরএলও রয়েছে: বিএনপিনিউজ ডটনেট। এই সাইটটির হোমপেজে থাকা তিনটি ক্যাটাগরির ১২টি খবরের সবগুলোতেই বিএনপি-বিরোধী ভাষ্য প্রচারিত হয়েছে।
রিজভীর ভুয়া বক্তব্যের গ্রাফিক কার্ডটি প্রচার করা ১৯টি পেজের অন্তত ছয়টিতে এর আগেও ভুয়া বা অপতথ্য পোস্ট করার নজির রয়েছে। এদের মধ্যে বিএনপি-নামা (১, ২) ও বাংলা পলিটিক্স (১, ২) নিয়ে অন্তত দুইটি করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন পাওয়া যায় । হ্যাশট্যাগ বিএনপি, খালেদা জিয়ার অনুসারী, খালেদা জিয়ার সৈনিক, এবং বিএনপি নিউজ আপডেট নামের পেজে পোস্ট করা মিথ্যা তথ্য নিয়েও যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
রুহুল কবির রিজভীর নামে এ ধরনের ভুয়া উদ্ধৃতি ছড়ানোর ঘটনা নতুন নয়। তার নামে তৈরি ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়ানো অপতথ্য নিয়ে অতীতেও ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গত দুই বছরে তার নামে ভুয়া বা বিকৃত বক্তব্য ছড়ানোর ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৪ বার, যেগুলো যাচাইও করেছে তিনটি তথ্যযাচাই প্রতিষ্ঠান। যেমন, এবছর আগস্টে রিউমর স্ক্যানারের একটি যাচাই প্রতিবেদনে দেখা যায়, রিজভীর একটি বক্তব্যের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল ফেসবুকে।
একই রকমের বক্তব্য বিকৃতি নিয়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরেও ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। এবছর ফেব্রুয়ারি এবং ২০২২ সালের মে মাসে রিজভীর নামে ছড়ানো ভুয়া বক্তব্য নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বুম বাংলাদেশ ও রিউমর স্ক্যানার। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ফ্যাক্ট-ওয়াচের আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, “বিএনপির সমাবেশ ঠেকাতেই করোনাভাইরাস সৃষ্টি করেছে সরকার” এমন একটি বক্তব্য রিজভীর নামে ছড়ানো হয়েছিল।