ডিসমিসল্যাব
অনলাইন প্রতারণার হাত থেকে যেভাবে বাঁচবেন
ডিসমিসল্যাব
ডিজিটাল প্রতারণার সর্বশেষ কৌশলগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা একটি ক্লান্তিকর বিষয়। প্রতারকেরা যেন সবসময়ই এক ধাপ এগিয়ে থাকে। তবে আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাত্র একটি সহজ বিষয় বুঝলেই এসব প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ খোয়ানোর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে, আর তা হলো: তাড়াহুড়ো না করা।
আদতে, স্ক্যামাররা যেসব কৌশল অবলম্বন করে তার মধ্যে অন্যতম হলো মানুষকে তাড়াহুড়ার মধ্যে ফেলা। দ্রুত কিছু করতে হবে এমন চিন্তাই সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিকর। বৈধ কোনো ছাড়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করা, তথ্য মূল্যায়ন এবং সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় দ্রুত কিছু একটা করার তাড়না।
অনলাইন কেনাকাটা ও ব্যাংকিংয়ের ওপর আমাদের নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কোভিড লকডাউন। এই প্রবণতার সুযোগ নিয়ে প্রতারক চক্রও আরও সক্রিয় হয়ে বিস্তৃত পরিসরে ফাঁদ পাতছে। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এফ৫-এর মতে, বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে শুধু ফিশিং অ্যাটাকই বেড়েছে স্বাভাবিক বার্ষিক গড়ের চেয়ে ২০০ শতাংশ।
মানুষ প্রায়ই যে প্রতারণার খপ্পড়ে পড়ে, তার মধ্যে একটি হলো: কোনো সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান বা সরকারি ওয়েবসাইটের আদলে বানানো নকল সাইটের ফাঁদে পা দেওয়া। গ্রাহকদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, বেটার বিজনেস ব্যুরো-র মতে, গ্রাহকের রিপোর্ট করা প্রতারণাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এমন ভুয়া ওয়েবসাইট। ২০২২ সালে এর কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ক্ষতির পরিমাণ সম্ভবত আরও বেশি, কারণ আরও অনেক ঘটনা হয়তো রিপোর্টই করা হয়নি।
কোন বিষয়গুলো আসল ও নকল ওয়েবসাইটের পার্থক্য নির্ণয়ে প্রভাব ফেলে– তা মূল্যায়নের জন্য আমরা বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। আমাদের গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের আমাজন, আসোস, লয়েডস ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ ডোনেশন সাইট, পেপাল ও এইচএমআরসি- এই ছয়টি সাইটের আসল ও নকল সাইটের স্ক্রিনশট দেখানো হয়। অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যায় কমবেশি ছিল, কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষায় ২০০ জনের বেশি অংশ নিয়েছেন।
প্রতিটি গবেষণায়, স্ক্রিনশটগুলো দেখিয়ে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, সাইটগুলো আসল বলে মনে হচ্ছে কি না। এরপর তাদের ইন্টারনেট সম্পর্কিত জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা মূল্যায়নের জন্য আরও কিছু পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর আগের একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, ফেক নিউজ বা ফিশিং মেইল চিহ্নিত করতে পারার সঙ্গে মানুষের বিশ্লেষণী ক্ষমতার সংযোগ আছে।
মানুষ কোনো তথ্য সাধারণত দুইভাবে বিশ্লেষণ করে থাকে। প্রথম পদ্ধতিটি দ্রুত, স্বয়ংক্রিয়, অনুমান-নির্ভর এবং এর সঙ্গে আমাদের আবেগ জড়িয়ে থাকে। আমরা জানি যে, বিশেষজ্ঞরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রথম পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেন। দ্বিতীয় ধরনটি হলো ধীরগতিতে, ভেবেচিন্তে ও মাথা ঘামিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বিশ্লেষণাত্মক যুক্তির পরীক্ষায় ভালো করতে হলে দ্বিতীয় পদ্ধতিটিই বেশি কার্যকর, প্রথম পদ্ধতি নয়। তাই আমরা বিশ্লেষণী যুক্তি-চিন্তার কিছু কাজকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম, যেন আমরা বুঝতে পারি যে, মানুষ কোন পদ্ধতির দিকে বেশি ঝুঁকছে। প্রথম নাকি দ্বিতীয় পদ্ধতি।
আমাদের বিশ্লেষণী যুক্তি-চিন্তা পদ্ধতি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো কেমন ছিল, তার একটি উদাহরণ এরকম: “একটি ব্যাট ও বলের মিলিত দাম ১.১০ ইউএস ডলার। ব্যাটের মূল্য বলের থেকে ১ ডলার বেশি। তাহলে বলের দাম কত?”
আমাদের ফলাফলে দেখা গেছে, যাদের বিশ্লেষণী যুক্তি-চিন্তার দক্ষতা বেশি, তাদের মধ্যে সঠিকভাবে ভুয়া ও সত্যিকারের ওয়েবসাইটের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের হারও বেশি।
অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ তাড়াহুড়ায় থাকলে তাদের ফিশিং সাইট শনাক্ত করতে পারার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর ফলে দ্বিতীয় ধারার চেয়ে প্রথম ধারায় চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। আর স্ক্যামাররা চায় মানুষ যেন সতর্কভাবে এগুলো খুঁটিয়ে না দেখে, বরং আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। আর তাই আমাদের গবেষণার পরবর্তী ধাপটি ছিল অংশগ্রহণকারীদের সময় কম দেওয়া (প্রথম পরীক্ষায় ২০ সেকেন্ড থাকলেও এবার ভুয়া ও সঠিক সাইট শনাক্ত করতে ১০ সেকেন্ড সময় দেওয়া হয়)।
এবার আমরা অংশগ্রহণকারীদের নতুন একটি দল নিয়ে কাজ করি। দেখা যায়, যেসব অংশগ্রহণকারীদের হাতে যাচাই করার সময় কম ছিল, তাদের ভুল করার প্রবণতাও ছিল বেশি। যে দলের কাছে ২০ সেকেন্ড সময় ছিল, তাদের তুলনায় দ্বিতীয় দলের সঠিক ও ভুয়া ওয়েবসাইট সঠিকভাবে যাচাই করতে পারার হার প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কম ছিল।
আমাদের শেষ পরীক্ষায়, আমরা নতুন একদল অংশগ্রহণকারীকে জাল ওয়েবসাইট শনাক্ত করার ১৫টি টিপস দিয়েছিলাম (যেমন, ডোমেইন নাম চেক করুন)। আমরা অর্ধেক অংশগ্রহণকারীকে বলেছিলাম যথার্থতাকে অগ্রাধিকার দিতে, যত সময়ই লাগুক না কেন। বাকি অর্ধেককে বলা হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সঠিক-ভুল সাইট নির্ণয় করতে। দেখা যায়, নির্ভুলভাবে শনাক্ত করার চেষ্টা না করে যারা তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে গেছেন, তারাই বেশি ভুল করেছেন এবং পূর্বে দেওয়া ১৫টি টিপস নিয়েও মাথা ঘামাননি।
সব বয়সের মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে স্ক্যামাররা মানুষের সহজাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে ভুয়া ওয়েবসাইটগুলো চালানোর চেষ্টা করছে। স্ক্যামাররা প্রায়ই এমনভাবে সাইটগুলো ডিজাইন করে থাকে যেন মানুষ তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, কেননা তারা জানে যে এভাবে সিদ্ধান্ত নিলেই মানুষ ভুল করবে বেশি। ফলে লাভবান হবে তারা। যেমন, এমন ধরনের বিজ্ঞাপনের ব্যবহার যেখানে শিগগিরই কোনো অফার বা ডিসকাউন্ট শেষ হয়ে যাওয়ার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।
নকল ওয়েবসাইট শনাক্তের ক্ষেত্রে পরামর্শগুলো হলো: সতর্কভাবে সাইটের ডোমেইনটি পরীক্ষা করুন, প্যাডলক চিহ্নটি যাচাই করুন, গেট সেফ অনলাইনের মতো ওয়েবসাইট চেকারগুলো ব্যবহার করুন, বানান ভুলগুলো লক্ষ্য করুন এবং এমন বিষয় নিয়ে সন্দেহ করুন, যেগুলো সত্য হওয়ার কথা না। এই পরামর্শগুলো বাস্তবায়নে নিশ্চিতভাবেই সময় ও সক্রিয় প্রচেষ্টার প্রয়োজন। আর তাই নিঃসন্দেহে আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো পরামর্শ হলো- অনলাইনে তাড়াহুড়ো না করে শান্ত ও ধীরস্থির হোন।
ইয়ানিভ হ্যানক ও নিকোলাস জে. কেলির এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশনে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।