ফামীম আহমেদ

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব
ফিফার অফসাইড প্রযুক্তিতে খেলোয়াড়দের শরীরে চিপ বসানো হয় না
This article is more than 2 years old

ফিফার অফসাইড প্রযুক্তিতে খেলোয়াড়দের শরীরে চিপ বসানো হয় না

ফামীম আহমেদ

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব

কাতারে আয়োজিত ফুটবল বিশ্বকাপের একটি বিশেষ প্রযুক্তি নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে ফুটবলের নতুন সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তিটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দাবি করা হয়েছে, ফুটবলের মতো খেলোয়াড়দের শরীরে চিপ বা সেন্সর যুক্ত থাকে, যা দিয়ে খেলার সময় তাদের চলাফেরার তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

কিন্তু ফুটবল খেলোয়াড়দের শরীরে চিপ অথবা সেন্সর ব্যবহারের কোন সত্যতা খুঁজে পায়নি ডিসমিসল্যাব। 

গত নভেম্বর মাসের ২৬ তারিখ “জ্ঞানের জগৎ” নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টটিতে কাতার বিশ্বকাপে কিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করা হয়। পোস্টটির একটি অংশে বলা হয়,

“….. পাশাপাশি প্রত্যেকটি প্লেয়ারের বডিতেও অনুরূপ চিপ যুক্ত থাকে ফলে প্রতিটি খেলোয়াড়ের দেহের মোট 29টি পয়েন্ট (অঙ্গ প্রতঙ্গ) থেকে প্রতি মুহুর্তে অর্থাৎ প্রতি 1 সেকেন্ডে 50 বার শরীরের মুভমেন্ট এর তথ্য সংগ্রহ হতে থাকে ‍Artificial Intelligence এর কাজে ব্যবহৃত সেন্ট্রাল কম্পিউটারে (ছবি যুক্ত)।….” 

দাবিটি ফেসবুকের আরো বিভিন্ন গ্রুপে ও পেজ, একটি ব্লগপোস্টে এবং যমুনা টিভিতে প্রকাশিত এক ভিডিও প্রতিবেদনেও পাওয়া যায়। সেখানে অফসাইডের এই নতুন প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খেলোয়াড়দের শরীরে চিপ ব্যবহারের কথাটি উঠে আসে। নিচের স্লাইডশোতে দেখুন কিছু নমুনা।

যমুনা টিভির প্রতিবেদনের ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড থেকে যা বলা হয় তা হুবহু তুলে ধরা হলো: “প্লেয়ারদের শরীরে যে চিপ রয়েছে তার মাধ্যমে ২৯টি ডাটা পয়েন্ট রয়েছে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, প্লেয়ারদের গায়ে যে সেন্সর রয়েছে, তার মাধ্যমে ২৯টির মতো শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ডাটা কালেক্টিং পয়েন্ট রয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আল্টিমেটলি যে খেলোয়াড়ের কোনো অবস্থান অফসাইডের বাইরে গিয়েছে কিনা।”

ফ্যাক্টচেক

অফসাইড প্রযুক্তি নিয়ে প্রাথমিক সার্চে ফিফার ওয়েবসাইটে “সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি” শিরোনামে একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। এতে বলা হয়: প্রযুক্তিটি স্টেডিয়ামের ছাদের নিচে সংযুক্ত ১২টি ট্র্যাকিং ক্যামেরার মাধ্যমে কাজ করে; মূলত সেটির মাধ্যমে বল ও প্রতিটি খেলোয়াড়ের শরীরের ২৯টি ডেটা পয়েন্ট ট্র্যাক করা হয়। প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার ট্র্যাকিং ডেটা সংগ্রহের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। এই ২৯টি ডেটা পয়েন্টের মধ্যে খেলোয়াড়দের পা-সহ শরীরের সে সব অংশের তথ্য অন্তর্ভুক্ত যা অফসাইড নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। ফিফার এই বিস্তারিত ব্যাখ্যায় খেলোয়াড়দের শরীরে কোনো চিপ বা সেন্সরের কথা খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

তবে ফিফার এই বিশ্বকাপের বল যা ‘আল রিহলা প্রো’ নামে পরিচিত, সেই বলটিতে একটি আইএমইউ সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। ফুটবলটির ঠিক মাঝে বসানো এই সেন্সরটি প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার তথ্য পাঠাতে পারে।

একইভাবে ফিফার ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে গত বছরে আয়োজিত ‘লিভিং ফুটবল’ নামের এক অনুষ্ঠানে ফিফার ‘ফুটবল প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন’ সংস্থার পরিচালক ইয়োহানেস হলজমুয়েলার বলেন, ফুটবলের এই আধা-স্বয়ংক্রিয় অফসাইড প্রযুক্তিটি মূলত ‘লিম্ব ট্র্যাকিং’ বা ‘স্কেলেটাল ট্র্যাকিং’ প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। সেখানেও খেলোয়াড়দের শরীরে কোনো সেন্সর ব্যবহারের আলাপ করা হয়নি। 

পরবর্তীতে ফিফার ডিজিটাল হাব প্লাটফর্ম থেকে আলোচ্য সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে খেলোয়াড়দের শরীরের এই ডেটা পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ খেলোয়াড়দের শরীরে কিছু যুক্ত করে সেটি পরিমাপ করার কথা এখানে উল্লেখ নেই।

এছাড়া ‘স্কেলেটাল ট্র্যাকিং’ প্রযুক্তি নিয়ে আরো খোঁজ করতে গিয়ে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইন্টেল এর ‘রিয়েল সেন্স’ নামক ওয়েবসাইটে এর একটি পরিস্কার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে ‘স্কেলেটন ট্র্যাকিং’ প্রযুক্তিতে সেন্সর এবং ডেপথ ক্যামেরার মাধ্যমে একজন মানুষের গতিবিধি দেখা হয়। প্রযুক্তিটি হলিউডের স্পেশাল ইফেক্টসের মতো হলেও এক্ষেত্রে মানুষকে কোনো ধরনের বিশেষ পোশাক বা মার্কার পরতে হয় না।

অর্থাৎ, কেবল বাইরে থেকে সেন্সর এবং ডেপথ ক্যামেরার সাহায্যেই মানুষের গতিবিধি ট্র্যাক বা পর্যবেক্ষণ করা যায়। শরীরে কোনো সেন্সর বা চিপ লাগেনা। ইন্টেল রিয়েল সেন্সের সাইটে “টাইপস অব ট্র্যাকিং ডিফাইনড” শিরোনামের পোস্টেও ‘স্কেলেটাল ট্র্যাকিং’ এর ব্যাপারে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। 

ফিফার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তাদের অফসাইড নিরুপণের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাথে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এবং অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত। 

আরও জানতে এমআইটির স্পোর্টস ল্যাবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যানেট ই হোসোই এর সাথে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। তিনি বলেন, “এটা একেবারেই সম্ভব নয়। প্লেয়ারদের শরীরে মাইক্রো চিপস থাকার বিষয়টি শুনিনি। এরকম কোন প্রযুক্তি আদৌ ব্যবহার হচ্ছে নাকি সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে এবং তা কার্যকরী হবে না।”

সুতরাং, কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে অফসাইড নির্ধারণ প্রযুক্তিতে খেলোয়াড়দের শরীরে কোনো প্রকার চিপ বা সেন্সর ব্যবহার করার দাবিটি বিভ্রান্তিকর।

তবে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে খেলোয়াড়দের শরীরে চিপ বা সেন্সর ব্যবহার করার আলোচনা পাওয়া যায়। এই চিপের সাহায্যে একজন খেলোয়াড়ের শরীরের তাপমাত্রা, হৃদযন্ত্রের সঞ্চালন অবস্থা বুঝা সম্ভব। তবে প্রস্তাবিত চিপগুলো খেলোয়াড়ের শরীরে নয়, বরং পোশাকে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া, ২০১৬ সালে আর্জেন্টিনার ফুটবল ক্লাব তিগ্রে তাদের ‘পাগলাটে ভক্ত’ দের জন্যে ‘প্যাশনেট টিকেট’ এর ঘোষণা দিয়েছিল। এটি মূলত একটি চিপ যা দর্শকরা স্বেচ্ছায় নিজেদের শরীরে প্রবেশ করালে স্টেডিয়ামে কোনো টিকেটের প্রয়োজন হবে না। তবে সেই ক্লাবটির বরাতে নিশ্চিত করা হয়েছিল, ট্র‌্যাকার নেই বলে এতে কারো ব্যক্তিগত তথ্য ঝুঁকিতে পড়বে না।

আরো কিছু লেখা