ফামীম আহমেদ
আইনস্টাইন কি বলেছেন মৌমাছি উধাও হয়ে গেলে পৃথিবী টিকবেনা?
ফামীম আহমেদ
ইন্টারনেটের দুনিয়ায় প্রাণীজগৎ নিয়ে আছে দাবির ছড়াছড়ি। কিন্তু কখনো কি শুনেছেন মৌমাছির টিকে থাকার সাথে আছে পৃথিবীর টিকে থাকার সম্পর্ক? বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বরাতে এমনই একটি উক্তি মূলধারার সংবাদমাধ্যমসহ ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আইনস্টাইনের এমন কোনো উক্তির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গত ১৫ অক্টোবর ১৩ লাখ সদস্যের গ্রুপ ‘Women and e-Commerce Trust ( WE)’ এ একজন মধু বিক্রেতা মধুর গুনাগুণ নিয়ে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি মধুর গুরুত্ব বোঝাতে আইনস্টাইনের উক্তি ব্যবহার করেন। নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানীর বরাতে বলা হয়, “যদি পৃথিবীর সকল মৌমাছি কোনো কারনে মারা যায় তবে পৃথিবী থেকে ৪ বছরের মধ্যে মানুষ নামক প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটবে।” (মূল পোস্টের বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে।)
২০১১ সাল থেকেই মূলত এ ধরনের দাবি ছড়াতে দেখা গেছে। বিভিন্ন প্রোফাইল, গ্রুপ এবং পেজে বিভিন্ন সময় একই দাবি পোস্ট করা হয়। বিভিন্ন সময়ে মূলধারার গণমাধ্যমেও আইনস্টাইনের নামে একই উক্তি প্রচার করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক ফিচারে মৌমাছি নিয়ে আইনস্টাইনের এই উদ্ধৃতিটি প্রচার করা হয়েছে। একই বছরের জুলাই মাসে একাত্তর টিভির ইউটিউব চ্যানেলে “মৌমাছিহীন পৃথিবীর আয়ু হবে মাত্র ৪ বছর” শিরোনামের একটি প্রতিবেদনেও এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
সম্প্রতি গত মে মাসে দৈনিক বাংলার একটি ফেসবুক পোস্টেও এই উক্তিটি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ইউটিউবেও দুটি চ্যানেলেও (১, ২) এই উক্তিটি খুঁজে পাওয়া যায়।
মৌমাছি নিয়ে আসলেই কি এই উক্তি করেছেন আইনস্টাইন?
ডিসমিসল্যাব বিভিন্নভাবে আইনস্টাইনের নামে প্রচারিত এই উদ্ধৃতিটির খোঁজ করেছে। এ সংক্রান্ত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট স্নোপস-এ। ২০০৮ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা আইনস্টাইনের বই, বক্তব্য বা বিবৃতির মধ্যে খোঁজ চালিয়ে এমন কোনো উদ্ধৃতির হদিস পায়নি যেখানে মৌমাছি বা ৪ বছর-এর উল্লেখ আছে। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বই ‘দ্য নিউ কোটেবল আইনস্টাইন’ বইয়ে এর লেখকও এমন কোনো উক্তি খুঁজে পাননি বলে স্নোপস জানিয়েছে।
এই উক্তিটি কিভাবে এলো আর কিভাবেই বা আইনস্টাইনের উক্তি হিসেবে ছড়ালো তা নিয়ে স্নোপসের প্রতিবেদনে কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে ব্রাসেলসে মৌয়ালদের এক আন্দোলনে একটি প্রচারপত্রে সর্বপ্রথম এই ভুল বক্তব্য প্রচার করা হয়। মূলত ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ ফ্রেঞ্চ এপিকালচার’ নামের একটি সংগঠন প্রচারপত্রটি বিলি করে। তখনই আইনস্টাইনের বরাতে উক্তিটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেরুতে থাকে বলে স্নোপস জানিয়েছে।
মূলত কম মূল্যে মধু আমদানি করায় এবং চিনির দাম-বৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়েছিলেন মৌয়ালরা। এছাড়া বাইরে থেকে মধু আমদানির উপর কর কমানোর কারণেও তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন। সেই বছরের জানুয়ারি মাসে মৌয়ালদের সংগঠনটি ব্রাসেলসে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করে। তখন মৌমাছির গুরুত্ব বুঝানোর জন্যে মৌয়ালরা স্লোগান তুলেছিল, যদি আমরা মৌয়ালরা না থাকি, থাকবে না মৌমাছি। আর মৌমাছি ছাড়া হবে না খাদ্যশস্যসহ অন্য ফসল।
স্নোপসে উল্লেখিত আইনস্টাইনের জীবনী ও কাজ নিয়ে বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক, এলিস ক্যালাপ্রিসের সম্পাদিত ‘দ্য নিউ কোটেবল আইনস্টাইন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ সালে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে বইটির আরেকটি বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। যেটির নাম: ‘দ্য আল্টিমেট কোটেবল আইনস্টাইন’। এই বইটির ৪৭৯ পৃষ্ঠায় আইনস্টাইনের এই উক্তিটি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বইটিতে ১৯৫১ সালের একটি চিঠিও খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে আলোচিত উক্তির কাছাকাছি একটি বক্তব্য পাওয়া গেছে। বইটির ‘অন এন্ড টু চিলড্রেন’ অধ্যায়ের সেই চিঠির যে অংশটি এখানে তুলে ধরা হলো। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে,
“প্রিয় বাচ্চারা…… সুর্যের রশ্মি ছাড়া না হবে গম, পাবো না রুটি, না পাবো ঘাস, থাকবে না গবাদি পশু, না পাবো মাংস, না পাবো দুধ। সবকিছু ঠান্ডায় জমে যাবে। থাকবে না কোনো জীবন”
বইয়ের সুত্র বলছে, “ছয়জন ছোট বিজ্ঞানী” (Six Little Scientists) এই শিরোনামে লুইজিয়ানার ৬ শিশুর জন্যে ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বরে এই চিঠিটি প্রেরণ করেন আইনস্টাইন।
আইনস্টাইনের এই কথিত উক্তি নিয়ে আরেকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কোট ইনভেস্টিগেটর নামের একটি ওয়েবসাইটে। সেখানে তারা দেখিয়েছে, কিভাবে ১৮৫৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত আলোচ্য এই উক্তিটি বিবর্তিত হয়ে আইনস্টাইনের নামে ছড়িয়ে পড়েছে। কোট ইনভেস্টিগেটরের তথ্যানুযায়ী, সর্বপ্রথম বিষয়টির সঙ্গে আইনস্টাইনের নাম যুক্ত হতে দেখা যায় ১৯৪১ সালে। আর্নেস্ট এ ফরটিন নামের এক লেখক ‘কানাডিয়ান বি জার্নাল’-এ লেখেন: “আমার মনে পড়ে আইনস্টাইন বলেছেন, যদি পৃথিবী থেকে সকল মৌমাছি অপসারণ করি, তাহলে আমরা কমপক্ষে ১ লক্ষ গাছপালা হারিয়ে যাবে, বাঁচতে পারবে না।”
কোট ইনভেস্টিগেটরের সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়: বিষয়টির সঙ্গে ৪ বছরের সময়সীমার ব্যাপারটি যুক্ত হয়েছে ১৯৬৫ সালে, ফরাসী সাংবাদিক পিয়েরে পেস্কাউ এর লেখার মধ্য দিয়ে। প্যারিসভিত্তিক “La Vie des Bêtes et l’Ami des Bêtes” নামের একটি ম্যাগাজিনে পেস্কাউ লিখেছিলেন: আইনস্টাইন হিসেব করেছেন যে মৌমাছি বিলুপ্ত হয়ে গেলে মানুষের বেঁচে থাকার সময়সীমা হবে ৪ বছর।
মৌমাছির বিলুপ্তি হলে কি আসলেই মানুষও বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
পৃথিবীতে প্রায় বিশ হাজার প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। পরাগায়নে মৌমাছির গুরুত্ব আসলেই অনেক বেশি। মৌমাছি বিলুপ্ত হলে পৃথিবীর খাদ্যচক্রে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু এর কারণে কি মানুষের বিলুপ্তি হতে পারে?
মৌমাছির বিলুপ্তিতে অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের জীবনে প্রভাব ফেললেও তার বিলুপ্তির ভবিষ্যতবাণী অতিরঞ্জিত। ২০০৬ সালে “প্রসিডিংস অফ দ্য রয়াল সোসাইটি বি বায়োলজিকাল সায়েন্সেস” এ প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ৬০ শতাংশের মতো খাদ্যশস্য জীব-পরাগায়নের উপর নির্ভর করে না। পরাগায়ণ শুধুমাত্র জীবের মাধ্যমেই হয় না, বাতাসের মাধ্যমে স্ব-পরাগায়নও হয়। মৌমাছি ছাড়াও আরো গুরুত্বপুর্ণ পরাগায়ন জীব রয়েছে; যেমন, পিঁপড়া। এছাড়া প্রজাপতি, বোলতা, বাদুড়সহ আরো অনেক কীট-পতজ্ঞ ও প্রাণী পরাগায়নে ভূমিকা রাখে।
মৌমাছির বিলুপ্তি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর ইকোলজি এন্ড হাইড্রোলজি’ এর ইকোলজিস্ট ড.মাইকেল পকক ২০১৪ সালে ফোর্বসকে বলেন, কীট-পতঙ্গরা উদ্ভিদের পরাগায়ন সেবায় যে অবদান রাখে অর্থের হিসাবে সেটি প্রায় ৪.১ বিলিয়ন থেকে ৬.৭ বিলিয়ন ডলারের মত। তার মধ্যে মৌমাছির অবদানের দিক দিয়ে পঞ্চম।
আইনস্টাইনের নামে প্রচারিত উক্তির সত্যতাকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি আরো বলেন, কোনো কারণে পৃথিবী থেকে কীটপতঙ্গ উধাও হয়ে গেলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। কিন্তু এর ফলে মানুষ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন কোনো আশঙ্কা নেই।
এভাবে একাধিক উৎস থেকে ডিসমিসল্যাবের তথ্য যাচাইয়ে দেখা যাচ্ছে, আইনস্টাইনের মৌমাছির নিরুদ্দেশে মানুষের বিলুপ্তি হওয়া বিষয়ক উক্তিটির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।