মিনহাজ আমান
একটি ছবি, দুইটি দাবি, বেঠিক সবই
মিনহাজ আমান
সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একটি সমাবেশের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিটি নিয়ে দুটি পরস্পর-বিরোধী দাবি পাওয়া যায়। এক পক্ষ দাবি করে ছবিটি গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বিএনপির গণসমাবেশের; অপর পক্ষ থেকে বলা হয় ছবিটি সম্পাদনা করে তাতে “ভুয়া জনসমাগম” দেখানো হয়েছে।
বেশ কিছু পেজ, গ্রুপ ও প্রোফাইল থেকে পাল্টাপাল্টি পোস্টের কল্যাণে ছবিটি শত শত বার শেয়ার হয়েছে। তবে, ডিসমিসল্যাব যাচাই করে দেখতে পেয়েছে, দুটি দাবির কোনোটিই সঠিক নয়।
১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশের দিন, এবং তার পরেও বিএনপির কয়েকজন কর্মীকে কখনো এককভাবে এবং কখনো অন্যান্য ছবির সঙ্গে এই ছবিটিকে পোস্ট করতে দেখা যায়।
যেমন: গত ১৩ অক্টোবর ‘লিটন আহমেদ’ নামের প্রোফাইল থেকে ছবিটি ১২ তারিখের মহাসমাবেশের অন্য ছবির সঙ্গে পোস্ট করা হয়েছিল, যা শতাধিকবার শেয়ার হয়েছে।
একইভাবে দলটির আরেক সমর্থক একটি গ্রুপে ছবিটি পোস্ট করে চট্টগ্রামের মতো খুলনাতেও সমাবেশ সফর করতে বলেন। কিছু পোস্টে বিএনপি মিডিয়া সেলের লোগোসহ একটি প্রচার-ভিডিও দেখা যায়, যা আলোচ্য ছবিটিকে অ্যানিমেট করে বানানো।
বিএনপি মিডিয়া সেলের এই গ্রাফিক্স পোস্টটিকে কেন্দ্র করে সমাবেশের পর দিনই, অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর, ‘Supporters of Bangladesh Awami League’ নামের ফেসবুক গ্রুপে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়।
এর ক্যাপশন ছিল: ‘চট্টগ্রামের সমাবেশ সুপারফ্লপ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভুয়া জনসমাগম দেখাতে ফটোশপ এর আশ্রয় নিল বিএনপি। একই জনসভায় দুইটি মঞ্চ স্থাপন কেবল বিএনপির গুজব সেলের দ্বারাই সম্ভব!’
২ লাখ ৩৪ হাজার বেশি ভিউয়ের এই ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে, সম্পাদনার মাধ্যমে সেই ছবিতে দুটি মঞ্চ দেখানো হয়েছে। হুবহু একই ভিডিও আরও অন্তত ৫০টি পেজ, গ্রুপ ও ভেরিফায়েড প্রোফাইলে পোস্ট ও শেয়ার হতে দেখা যায়। (১, ২, ৩, ৪)
এই ছবিটি এবং সংশ্লিষ্ট দাবি যাচাই করতে গিয়ে দুটি প্রশ্ন বিবেচনায় আনা হয়েছে।: প্রথমত, ছবিটি বিএনপির ১২ অক্টোবরের জনসমাবেশের কিনা; দ্বিতীয়ত, দুটি মঞ্চ দেখাতে ছবিটি সম্পাদনা করা হয়েছে কিনা।
প্রথমেই রিভার্স ইমেজ সার্চ করে একটি পুরনো ব্লগ পোস্টের লিংক মেলে। সেখানে এই ছবির একটি তুলনামূলক স্পষ্ট সংস্করণ পাওয়া যায়। ব্লগটি চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা বিএনপির নামে। সাইটে ছবিটি থাকলেও সেটি কবে, কখন আপলোড করা হয়েছে তার উল্লেখ নেই।
পরবর্তীতে সাইটের সোর্স কোড পরীক্ষা করে এবং দুটি টুলে আলাদাভাবে যাচাই করে দেখা যায়, ব্লগ-সাইটটিতে ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরের পর থেকে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। অর্থাৎ, সাইটটিতে যা আছে তার সবই ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরের আগে আপলোড করা।
প্রাথমিকভাবে, এর মানে দাঁড়ায় যে ছবিটি ১২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত বিএনপির সমাবেশের অনেক আগে তোলা হয়েছে।
এবার ব্লগে পাওয়া তুলনামূলক স্পষ্ট ছবিটি দিয়ে ফের রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হয়। এই সার্চের ফলাফলে ‘নিউজ ডট প্রিয় ডটকম’ নামে একটি লিংক বেরিয়ে আসে। সেই লিঙ্কে ক্লিক করে দেখা যায় খবরটিই এখন আর সাইটটিতে নেই। কিন্তু অকার্যকর সেই লিংকটিতে একটি তারিখ রয়েছে: ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি।
এবার ২০১২ সালের ৮ থেকে ১০ জানুয়ারি তারিখের মধ্যে কী-ওয়ার্ড সার্চ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত একটি খবরের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই খবরে আলোচ্য ছবিটি রয়েছে। খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি এবং তার শিরোনাম ছিল, “সমাবেশ মঞ্চে খালেদা”।
বিডিনিউজ২৪ ডটকমে প্রকাশিত ছবিটিও আকারে ছোট, এবং এটির ফটোগ্রাফার কে বা ছবিটি কখন তোলা হয়েছে – তার উল্লেখ নেই। তবে, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ছবিটি আসলে ১০ বছর পুরনো এবং সেই সময় চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত একটি সমাবেশের।
কিন্তু, ছবিটি কি এডিট বা বিকৃত করে দুটি মঞ্চ বসানো হয়েছে?
ইতিমধ্যে পাওয়া সকল তথ্য কী-ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করে একটি ইংরেজি ভাষার সাইটের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সাইটে, ছবির পাশাপাশি সেটি তোলার দিন-তারিখ এবং অবস্থানের উল্লেখ রয়েছে। সাইটটি অভিজ্ঞ আলোকচিত্র শিল্পী মনিরুল আলমের, এবং তাঁর স্ব-নামে। ছবির মেধাস্বত্বও তাঁর বলে ছবির নিচে লেখা রয়েছে। সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া ছবি এবং মনিরুল আলমের ১০ বছর আগে তোলা ছবিটি হুবহু একই এবং উভয় ছবিতে দুটি আলাদা মঞ্চের মতো কাঠামো রয়েছে।
মনিরুল আলম বর্তমানে ইউরোপিয়ান প্রেস ফটো এজেন্সিতে কাজ করছেন। প্রথমে মেসেঞ্জারে এবং পরে ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি নিশ্চিত করেন যে, জনসভার ছবিটি তাঁর তোলা এবং তিনি সেসময় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার হয়ে সমাবেশটির ছবি তুলতে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমার মনে আছে ছবিটির জন্যে একটি উঁচু বাড়ির ছাদে উঠতে হয়েছিল এবং সেখানে আরো অনেক ফটো-সাংবাদিক ছিলেন।”
অর্থাৎ, চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে বিএনপির সমাবেশের এই ছবিটি ২০১২ সালের – ২০২২ সালের নয়; বিএনপি মিডিয়া সেলের লোগোযুক্ত প্রচার-ভিডিওটিতে পুরনো ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যা দলটির কর্মীরা শেয়ার করেছেন; এবং এটিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে যে সম্পাদনার মাধ্যমে বিকৃত করে ছবিটিতে মঞ্চ বাড়ানো হয়নি। এই ছবি নিয়ে সম্প্রতি ছড়ানো দুটি দাবিই, বেঠিক।