নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
নভেম্বর ১৯, ২০২৫
১৭:১৬:৫৫
শিশুর আচরণে ডাকাতের মন গলে যাওয়ার সাজানো কনটেন্টকে সংবাদমাধ্যমে আসল বলে প্রচার

শিশুর আচরণে ডাকাতের মন গলে যাওয়ার সাজানো কনটেন্টকে সংবাদমাধ্যমে আসল বলে প্রচার

নভেম্বর ১৯, ২০২৫
১৭:১৬:৫৫

নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

ডাকাতির উদ্দেশ্যে দোকানে ঢুকে, শিশুর আচরণে সিদ্ধান্ত বদল করে ডাকাত দোকান থেকে চলে যায়- এমন দাবিতে ভিডিও প্রচারিত হতে দেখা গেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে। একাধিক গণমাধ্যমকে এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দেখা যায়। ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকে দেখা যায়, বাংলাদেশি গণমাধ্যমের পোস্ট করা ভিডিওটি একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য বানানো ভিডিও।

“শিশুর সরলতায় গলে গেলো মন, টাকা ফিরিয়ে দিয়ে চুমু দিল ডা’কাত!” – এমন ক্যাপশনে একটি ভিডিও (আর্কাইভ লিংক) পোস্ট হতে দেখা যায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম কালবেলা ওয়ার্ল্ড এর ফেসবুক পেজ থেকে। ১ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে, মুখ কালো কাপড়ে ঢেকে এক ব্যক্তি একটি দোকানে ঢুকে দোকানদারের কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেয়।

এ সময় দোকানদারের পাশে বসা ছোট মেয়েটি হাতে থাকা ললিপপ ডাকাতের দিকে এগিয়ে দেয়। এতে লোকটি মত বদলে টাকা ফিরিয়ে দেয়, এবং শিশুটিকে আদর করে চলে যায়। ভিডিওর ৪১ সেকেন্ডে অডিওতে বলা হয়, আলোচিত এই ঘটনাটি পাকিস্তানে ঘটেছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ঘটনাটিকে সত্য বলে মনে করে বিভিন্ন মন্তব্য করেন।

এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, “পাকিস্তানে সব সম্ভব।” আরেকজন মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশে হলে শিশুর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সবকিছু নিয়ে যেতো,বাংলাদেশে মানুষের সাথে বহির্বিশের সাথে এটাই তফাৎ।” (বানান অপরিবর্তিত) একই ভিডিও কালবেলা ওয়ার্ল্ড নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলেও আপলোড হতে দেখা যায়।

এই ঘটনাটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশের একাধিক (,,) গণমাধ্যম। পাকিস্তানের গণমাধ্যম এআরওয়াই নিউজের বরাতে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশিত ১৯ নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়, “শিশুটির নিষ্পাপ আচরণে নিজেকে সামলাতে পারেনি সশস্ত্র ডাকাত। লুটে নেওয়া টাকা-পয়সা ফেরত দিয়ে উল্টো মেয়েটির মাথায় চুমু খেয়ে বিদায় নিয়েছে। এ যেন কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য। সম্প্রতি এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঘটনাটি ঘটেছে পাকিস্তানে। তবে ঠিক কোন এলাকার ভিডিও, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।” সব প্রতিবেদনেই ঘটনাটি পাকিস্তানের বলে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া, একাধিক ফেসবুক প্রোফাইল (,,) ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট (,) থেকেও ভিডিওটি শেয়ার করতে দেখা যায়। 

ভিডিওগুলোর সূত্র যাচাই করতে গেলে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে একটি ইউটিউব চ্যানেল। চ্যানেলটির নাম “কামরান টিম অফিসিয়াল।” কামরান টিম অফিসিয়াল থেকে আপলোড হওয়া ১৬ নভেম্বরের একটি শর্টসের সঙ্গে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর হুবহু মিল পাওয়া যায়। শর্টসটির ক্যাপশনে উর্দুতে লেখা, “ডাকাতের মন গলে গেল।” শর্টসের ভেতরে উর্দুতে লেখা, “মেয়েটি ভেবেছিল ডাকাতটি তার ললিপপ নিয়ে যাবে তাই সে নিজেই ললিপপটি ডাকাতকে দিয়ে দিল।” শর্টসের হ্যাশট্যাগে লেখা, “শর্টস ভাইরাল”, “শর্টস ফিড”, এবং “কামরান টিম অফিসিয়াল।”

শর্টসের ডেসক্রিপশন অংশে লেখা, “এই ভিডিওটি একটি মঞ্চস্থ ভিডিও এবং এতে উপস্থিত ব্যক্তিরা আসলে নাটকের চরিত্র (অভিনেতা) এবং এই ভিডিওতে দেখানো অস্ত্রগুলো নকল। এই ভিডিওর উদ্দেশ্য কারও অনুভূতিতে আঘাত করা নয়। এই ভিডিওটি কোনো ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে না। এই ভিডিও শুধুমাত্র বিনোদনের উদ্দেশ্যে তৈরি। ধন্যবাদ।” এখন পর্যন্ত ১০ লক্ষেরও বেশি বার দেখা হয়েছে ভিডিওটি।

কামরান টিম অফিসিয়াল চ্যানেলটি বিশ্লেষণ করলে প্রায় একই স্ক্রিপ্ট এবং প্রেক্ষাপটে একাধিক ভিডিও পাওয়া যায় (,,)। এই ভিডিওগুলোতে একজন অস্ত্র নিয়ে ডাকাত সেজে দোকানে ঢুকে। পরবর্তীতে কোনো ঘটনাচক্রে ডাকাতি না করে চলে যায়। বেশিরভাগ ভিডিওতে দুজন মানুষকেই বারবার দেখা যায়। এছাড়া ডাকাত সংক্রান্ত একাধিক ভিডিও এই চ্যানেলে পাওয়া যায়। চ্যানেলটির প্রায় ৮২ হাজার সাবস্ক্রাইবার। চ্যানেলটি পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হয় এবং তাদের সকল ভিডিওতেই তারা সতর্কবার্তা দিয়ে বলে, ভিডিওগুলো শুধুই বিনোদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত। 

পাকিস্তানের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও ভিডিওটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে দেখা যায়। গত ১৭ নভেম্বরে একাধিক (,,) প্রতিবেদন সামনে আসে। দ্য নিউট্রাল এর প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের একটি ভাইরাল সিসিটিভি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে একটি ডাকাতির প্রচেষ্টা অপ্রত্যাশিতভাবে আবেগপ্রবণ ঘটনায় রূপ নেয়, যখন একজন মেয়ে শিশু সশস্ত্র ডাকাতের দিকে একটি ললিপপ বাড়িয়ে দেয়। 

এর একদিন পর ১৮ নভেম্বরে ভারতের একাধিক (,) গণমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নিউজ ১৮ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়া একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায় কীভাবে একটি ভয়ঙ্কর ডাকাতি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কিছুতে পরিণত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে পাকিস্তানের কোথাও।

ভিডিও যাচাই করে ইতিমধ্যে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের গণমাধ্যম দ্য কারেন্ট। প্রতিবেদনটিতে যে ভিডিওটি যাচাই করা হয়েছে তা কালবেলার পোস্ট করা ভিডিওর সঙ্গে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের পোস্ট করা প্রতিবেদনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ভিডিওটি প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে মূলধারার গণমাধ্যমে পুনরায় প্রচার করে।

দ্য কারেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিওটি কামরান টিম অফিসিয়াল নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে নির্মিত। চ্যানেলটিতে কমপক্ষে ১৭২টি ভিডিও রয়েছে, যার বেশিরভাগই সম্পাদিত সিসিটিভি ভিডিও। ভিডিওগুলো হাস্যরস থেকে শুরু করে সামাজিক বার্তা দেয়। এছাড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ছড়িয়ে পড়া ডাকাতির ভিডিওতে দেখানো দোকান, অভিনেতাদের পাশাপাশি খেলনা বন্দুকটিও বিভিন্ন ভিডিওতে একাধিকবার দেখানো হয়েছে।

সাজানো ভিডিও কীভাবে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে তৈরিকৃত সাজানো ভিডিও ভারতে ভুল তথ্য আকারে বিস্তারের ঘটনা নিয়ে ডিসমিসল্যাব ২০২৪ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

আরো কিছু লেখা