আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
অক্টোবর ৩০, ২০২৫
১৮:০৪:৩৯
ইরানে হিজাবের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়নি

ছড়াচ্ছে পুরোনো আন্দোলনের ভিডিও

ইরানে হিজাবের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়নি

অক্টোবর ৩০, ২০২৫
১৮:০৪:৩৯

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

ইরানে হিজাবের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে দাবিতে বেশকিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, নারীরা রাস্তায় জড়ো হয়ে আগুনে হিজাব পুড়িয়ে উদযাপন করছেন। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি হিজাব আইন বাতিলের কোনো উদযাপনের নয়, বরং মাসা আমিনি হত্যার বিরুদ্ধে চলা আন্দোলনের একটি ঘটনার দৃশ্য। ইরানে এখনো হিজাব সংক্রান্ত আইন বহাল আছে, শুধু তার প্রয়োগে কিছুটা শিথিলতা এসেছে বলে নিশ্চিত হয়েছে ডিসমিসল্যাব। 

ইরানি তথ্য যাচাই সংস্থা ফ্যাক্টনামেহ ও এএফপি ফ্যাক্টচেকের আলাদা যাচাইয়ে জানা যায়, ইরানে হিজাব সংক্রান্ত কোনো সরকারি ঘোষণা বা আইন সংশোধনের দলিল নেই; বরং যার মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই অপতথ্য ছড়িয়েছে তিনি দেশটির রাজনীতিক মোহাম্মদ রেজা বাহোনার। এই রাজনীতিবীদ নিজেই পরবর্তীতে তার বক্তব্য সংশোধন করে বলেছেন, তিনি আইন নয়, বরং প্রচলিত পদ্ধতির পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন।

“ইরান হিজাব পরার আইনি বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে। এখন হিজাব পরবে কি না — সেটা সম্পূর্ণই সেখানে নারীদের নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে, কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা আর নেই….. ইরানের জনগণ রাস্তায় নেমে সম্মিলিতভাবে হিজাব পুড়িয়ে আনন্দ উদযাপন করছে।”- এই ক্যাপশনে একটি ভিডিও পোস্ট হতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। একই ক্যাপশনে ভিডিওটি পোস্ট করতে দেখা যায় বিভিন্ন ফেসবুক (, , ) এবং ইনস্টাগ্রাম (, , ) ব্যবহারকারীকে।

ভিডিওতে দেখা যায় আগুনের সামনে সাদা পোশাক পরিহিত এক নারী নাচছেন। নাচতেই নাচতে একটি কাপড় আগুনে ছুড়ে মারছেন। এরপর আবার ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছেন। তার দেখাদেখি কালো পোশাক পরিহিত দুজন নারীও এগিয়ে এসে আগুনে কাপড় ফেলছেন। এই সময় ঘিরে থাকা জমায়েতকে হাততালি দিয়ে উদযাপন করতে দেখা যায়।

ভিডিওর সূত্র যাচাই করতে গেলে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে ভয়েজ অব আমেরিকার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলের একটি ভিডিও। ২০২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরে আপলোড হওয়া এই ভিডিওটির শিরোনাম ছিল, “ইরানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে নারীরা আগুনে হিজাব নিক্ষেপ করেন।”

ভয়েজ অব আমেরিকার ভিডিওর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দৃশ্যের হুবহু মিল পাওয়া যায়। ওই ভিডিওর বর্ণনায় লেখা হয়, “একজন নারী ইরানের সারি শহরের একটি রাস্তায় আগুনে তার হিজাব ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। কঠোর পোশাকবিধি কার্যকর করার দায়িত্বে থাকা নীতি পুলিশ কর্তৃক এক তরুণী গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মৃত্যুতে দেশজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন জোরদার হয়েছে।” আরও বলা হয় ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনি “অনুপযুক্ত পোশাক” পরার অভিযোগে তেহরানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত সপ্তাহে মারা গেলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

অর্থাৎ, ভিডিওটির হিজাবের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ায় হওয়া কোনো উদযাপনের নয়, বরং ২০২২ সালে “অনুপযুক্ত পোশাক” পরিধানের কারণে গ্রেপ্তারের পর মাসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে হওয়া একটি বিক্ষোভের দৃশ্য। 

হিজাবের বাধ্যবাধকতা কি তুলে নেওয়া হয়েছে?

হিজাবের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে কিনা এই বিষয়ে জানতে কিওয়ার্ড সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। সার্চে সামনে আসে ইরান ইন্টারন্যাশনালের ৭ অক্টোবরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন যার শিরোনাম হলো, “তেহরানের রাস্তায় যখন পরিবর্তনের ছাপ, রক্ষণশীলরা লড়ছেন হিজাব আইন নিয়ে।” প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির প্রজাতন্ত্রের স্বার্থ-নির্ধারণী পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ রেজা বাহোনার রিপোর্টারদের বলেন “(আপাতত) সাধারণ সিদ্ধান্ত হলো, কোনো বাধ্যতামূলক হিজাব আইন কার্যকর নেই।” এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির রক্ষণশীলরা প্রতিবাদও জানান।

অধিকতর যাচাই করতে গিয়ে আইআরআইবি ওফোগকে (ফারসি: দ্য হরাইজন চ্যানেল) দেওয়া মোহাম্মাদ রেজা বাহোনারের আরেকটি সাক্ষাৎকার খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। সাক্ষাৎকারের ক্লিপটির শিরোনাম ছিল, “হিজাব নিয়ে অবস্থান সংশোধন করেছেন বাহোনার/ আমি ভুল ভাবে বলেছি”। সাক্ষাৎকারে  তাকে বলতে শোনা যায়, “উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বলতে চায়, আমাদের পবিত্র শরিয়ায় হিজাব একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় অথবা এর গুরুত্ব একটু কমানো দরকার বা অন্য কোনোভাবে পরিবর্তন আনা দরকার— না। এটি স্পষ্টতই আমার বক্তব্য নয়। আমি আমার বক্তব্যটি পুনরায় বলছি, আমি কোনো ভাবেই মূল্যবোধকে পুনর্বিবেচনার কথা বলছি না। আমি বলছি পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা করতে। অর্থাৎ, দেশে একটি বিশাল সাংস্কৃতিক জাগরণ শুরু করা উচিত।”

বিভ্রান্তি কাটাতে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে ইরানভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টনামেহ’র এডিটর-ইন-চিফ ফরহাদ সোজানচির সঙ্গে। তিনি ডিসমিসল্যাবকে জানান, “বাধ্যতামূলক হিজাব সংক্রান্ত আইনগুলো তুলে নেওয়া হয়নি।”

সোজানচি আরও জানান ফ্যাক্টনামেহ মোহাম্মদ রেজা বাহোনারের এই বক্তব্যটি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ফারসি ভাষায় লেখা এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় চলতি মাসের ৬ তারিখে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয় চলতি বছরের ২৫ মে সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে একটি প্রশ্নের জবাবে সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের ঘালিবাফ “হিজাব এবং সতীত্ব আইন” আপাতত মুলতবী করা হয়েছে বলে জানান। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সংসদের সভাপতিত্বকারী বোর্ডের সদস্য আলিরেজা সালিমিও একই কথা বলেন।

ফ্যাক্টনামেহ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী “হিজাব এবং সতীত্ব আইন” আপাতত মুলতবী হলেও হিজাব সংক্রান্ত অন্যান্য আইন এখনো বহাল আছে। ইরানের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৬৩৮ ধারার উল্লেখ করে বলা হয়, কোনো নারী যদি উন্মুক্ত স্থান এবং রাস্তায় শরয়ী হিজাব না পরে বের হলে তার শাস্তি হবে ১০ দিন থেকে ২ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ২ থেকে ১০ মিলিয়ন রিয়াল জরিমানা।” এছাড়া একাধিক নিয়ম ও আইন দ্বারা হিজাবের বাধ্যবাধকতা কার্যকর করা হয় যা এখনো সরানো হয়নি।

অর্থাৎ, হিজাবের বাধ্যবাধকতার দাবিটি তুলে নেওয়ার দাবিটিও সত্য নয়। 

ফ্যাক্টনামেহ’র এডিটর-ইন-চিফ ফরহাদ সোজানচি ডিসমিসল্যাবকে বলেন, “যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা এমন কোনো দাবি করেন যা পুরনো আইনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে, তখন মানুষের কিছু সতর্কতামূলক বিষয়ের দিকে নজর রাখা উচিত। যেমন, সেই দাবির পক্ষে কোনো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট না থাকা, অস্পষ্ট বা বেছে বেছে কথা বলা এবং রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর ঘটনার ঠিক আগে বা পরে এমন ঘোষণা আসা। যদি আইনি বাস্তবতা বা বাস্তব প্রয়োগের সঙ্গে সে বক্তব্য না মেলে, তবে সেটি আসল আইনের পরিবর্তনের চেয়ে রাজনৈতিক কৌশল বা বা বাড়িয়ে বলার সম্ভাবনাই বেশি।” হিজাবের বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে হিজাব আইন বলবত থাকা অবস্থায় কিছুই পরিবর্তন হবে না। তার মতে আগের চেয়ে কড়াকড়ি শিথিল হয়েছে হয়তো, তবে আইন বাতিল হয়ে যায়নি। 

ভুয়া এই দাবির শুরু যেভাবে

ফ্যাক্টনামেহ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এনতেখাব নিউজকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ রেজা বাহোনার বলেন: “বর্তমানে হিজাবের জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এবং কোনো নগদ, ফৌজদারি বা বিচার বিভাগীয় জরিমানা নেই, আর এর জন্য কোনো আইনও নেই।” তিনি আরও বলেন, “আইনি ও বিচারিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সেই সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলই হিজাব বিলটিকে মুলতবী করে দিয়েছে এবং এটি আর কার্যকরযোগ্য নয়। আগে যে বাধ্যবাধকতাগুলো ছিল, উদাহরণস্বরূপ, ফারাজা (পুলিশ) বা অন্য যারা কিছু করতে চাইত, সেগুলোর এখন আর কোনো আইনি বৈধতা নেই।” তবে ফ্যাক্টনামেহ তার এই বক্তব্যকে ভুয়া বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু তার এই বক্তব্যের জের ধরেই ছড়িয়ে পড়ে মিথ্যা দাবিটি।

এএফপি ফ্যাক্টচেকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যম উইবোতে একটি ভিডিও আপলোড করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “হিজাব (আইন) এর আর কোনো কার্যকারী ক্ষমতা নেই।” ভিডিওর ভেতরে চীনা টেক্সটে লেখা, “সম্প্রতি ইরানের গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে যে ইরানের স্বার্থ-নির্ধারণী পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ রেজা বাহোনার বলেছেন হিজাব আইন আর বাধ্যতামূলক নয়। নীতি পুলিশের পুরোনো নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ে নারীদের শাস্তি দেওয়ার কোনো অধিকার নেই।”

ভিডিওটি শুরু হয় একজন নারী তার স্কার্ফ সরিয়ে ফেলার দৃশ্য দিয়ে এবং তিনি মান্দারিন ভাষায় বলেন, “ইরান ছাড়ার পর যে কথা প্রথম মাথায় এসেছে, তা হলো আমি এখন স্বাধীন!” এরপর ভিডিওটিতে হিজাব পরা ও হিজাব ছাড়া নারীদের বিভিন্ন ক্লিপ দেখানো হয়। ভিডিওটি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে বলেও জানা যায় প্রতিবেদনটি থেকে।

ভিডিওটি ফ্যাক্টচেক করে এএফপি বলে যে সেসময় দাবির সঙ্গে প্রচারিত ভিডিওটি ছিল মূলত একজন ইরানি ব্লগারের আগস্টে সামাজিক মাধ্যম দোয়িনে প্রকাশিত একটি ভিডিও। এই ভিডিওতে তিনি ওমানে পৌঁছানোর পর নিজের হিজাব খোলার দৃশ্য ধারণ করেন এবং ওমানে হিজাব পরিধানে বাধ্যবাধকতা নেই।

ইরানের সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের পরিচালক বাহার গান্দেহারি এএফপিকে বলেন, “হিজাব রাখার বাধ্যবাধকতা আইনত বাতিল করা হয়নি। এটি এখনো এদেশের আইন হিসেবে বিদ্যমান। শুধুমাত্র প্রয়োগের মাত্রা পরিবর্তিত হয়েছে, তবে সেটিও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ইরানের কোন শহর ও প্রদেশে ঘটনা ঘটছে তার ওপর নির্ভর করে।”

বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া দাবির সঙ্গে যুক্ত ভিডিওটি প্রথম ছড়াতে দেখা যায় ভারতে। হিন্দি (, ) এবং বাংলা (, ) ভাষায় ছড়াতে দেখা যায় এই ভিডিও। একই দাবি দেখা যায় ভারতের গণমাধ্যমেও। টিভি নাইনের একটি ভিডিও প্রতিবেদনেও বলা হয় ইরানের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও খামেনির উপদেষ্টা আলি শামখানির মেয়ের বিয়ের ভিডিও ভাইরাল হলে সেখানে তার মেয়েকে হিজাব ছাড়া পোশাকে দেখা যায়। ফলে এটি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পরেই ইরানে একটি বড় পরিবর্তন আসে। ভিডিওর ১ মিনিট ১৩ সেকেন্ডে ইরানে নারীরা হিজাব থেকে মুক্তির পর উদযাপনের একটি দৃশ্য বলে মাসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে হওয়া আন্দোলনের ভিডিওর একটি অংশ ছবি আকারে দেখানো হয়।

এরপর এই দাবিটি প্রায়ই একই ক্যাপশনে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীরাও পোস্ট করতে শুরু করে ২৮ অক্টোবর থেকে।

ইরানের বিষয়ে কোনো তথ্য যাচাই করার ব্যাপারে ফরহাদ সোজানচির পরামর্শ, “যারা ইরানের ঘটনাগুলোকে নজরে রাখেন, তাদের জন্য মিডিয়া লিটারেসি বা সংবাদ বোঝার মূলনীতি হলো, ‘ফাঁকা বুলি’ আর ‘বাস্তবতা’-কে আলাদা করে দেখা। হঠাৎ বড় কোনো পরিবর্তনের ঘোষণা বেশিরভাগ সময়েই লোক দেখানো হয়ে থাকে। এগুলোর উদ্দেশ্য হলো মানুষের আবেগ বা আন্তর্জাতিক ধারণা প্রভাবিত করা, আসল আইনি পরিবর্তন নয়। এমন যেকোনো দাবিকে সবসময় একাধিক বিশ্বাসযোগ্য সূত্র এবং মাঠে প্রয়োগের প্রমাণ দিয়ে যাচাই করে নেবেন।”

আরো কিছু লেখা