মো. তৌহিদুল ইসলাম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
অক্টোবর ২২, ২০২৫
১৭:০৬:৪৭
অগ্নিকাণ্ডের সুযোগে ছড়ানো হচ্ছে ভুয়া দাবি

অগ্নিকাণ্ডের সুযোগে ছড়ানো হচ্ছে ভুয়া দাবি

অক্টোবর ২২, ২০২৫
১৭:০৬:৪৭

মো. তৌহিদুল ইসলাম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশে সম্প্রতি একাধিক জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন দাবিতে ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়েছে। তবে ছড়ানো এসব পোস্টে সত্য তথ্যের পাশাপাশি রয়েছে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর দাবি। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে এ ধরনের অন্তত চারটি ভিডিও ফুটেজ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর দাবিতে ছড়ানো হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। 

দাবি ১

চকবাজার ইসলামী ব্যাংকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দাবিতে গত ১৯ অক্টোবর একটি ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওটি অন্তত এক সপ্তাহ পুরোনো।

“আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান” নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি ছড়ানো হয়। ক্যাপশনে লেখা ছিল, “এই মুহূর্তে চকবাজার ইসলামি ব্যাংকে ভয়াবহ আগুন,, নীরবে জ্বলছে সোনার বাংলাদেশ,,কি শুরু হলো দেশে,, চারিদিকে শুধু আগুন আর আগুন।” এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভিডিওটি অন্তত ২৫০ বার শেয়ার করা হয়েছে। দেখা হয়েছে অন্তত ২৬ হাজার বার। উক্ত পেজটি ছাড়াও ভিডিওটি একাধিক ফেসবুক পেজ ও প্রোফাইল থেকে পোস্ট করা হয়েছে (, , , , , )।

ভিডিওর একাধিক কিফ্রেম সার্চ করে ফেসবুক ও টিকটকে একই দৃশ্য সম্বলিত পুরোনো ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। গত ১২ অক্টোবর “চট্টগ্রাম প্রতিদিন ডিজিটাল” নামের একটি ফেসবুক পেজে ভিডিওটি আপলোড করে ক্যাপশনে জানানো হয়, এটি চট্টগ্রাম চকবাজার থানার পাশের ঘটনা। সামাজিকমাধ্যম টিকটকেও এক সপ্তাহ আগে আপলোড হওয়া একই ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির উপরের অংশে সম্পাদনা করে লেখা ছিল, “বিপদ কাউকে বলে আসে না। সবাই নিরাপদে থাকুন এটাই চাই। ১২/ ১০/ ২০২৫ চট্টগ্রাম, চকবাজার।”

অর্থাৎ, চট্টগ্রামের চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি গত ১৯ অক্টোবরের নয়, এক সপ্তাহ আগের। 

দাবি ২

পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দাবিতেও একটি ভিডিও গত ১৯ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি “আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২৫” উপলক্ষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আয়োজিত ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ মহড়ার একটি ভিডিও, যা গত ১৩ অক্টোবর কলেজটির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়।

ফেসবুকে একটি প্রোফাইল থেকে পোস্ট হওয়া ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা হয়, “পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে  আগুন। পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে মুহূর্তের মধ্যেই ক্যাম্পাসজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে, শিক্ষক-স্টাফরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন উদ্ধার তৎপরতা চালাতে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল ১০টার দিকে কলেজের একটি ভবনে হঠাৎ ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। এখনও পর্যন্ত আগুনের উৎস নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়েছেন কি না তা এখনো জানা যায়নি, স্থানীয় প্রশাসন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।”

এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভিডিওটি ১৭ বার শেয়ার করা হয়েছে। উক্ত প্রোফাইল ছাড়াও ভিডিওটি একাধিক ফেসবুক পেজ ও প্রোফাইল থেকে পোস্ট করা হয়েছে (, , , , ,)

ভিডিওটির সত্যতা যাচাইয়ে একাধিক কিফ্রেম সার্চ করে “দৈনিক পাবনার আলো” ও “স্বাধীন বার্তা” নামের দুইটি (, ) ফেসবুক পেজে কাছাকাছি দৃশ্যের দুইটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও “পাবনা ফায়ার স্টেশন” নামের একটি পেজে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা ও ছবিসহ একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়,  গত সোমবার (১৩ অক্টোবর) “আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২৫” উপলক্ষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ব্যবস্থাপনায় পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ড বিষয়ক মহড়া আয়োজিত হয়। সম্প্রতি ছড়ানো ভিডিওটি সেই মহড়ারই একটা অংশ বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়।

পরবর্তী যাচাইয়ে পাবনা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক সাইফুল আহসান ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। তিনি জানান, এটি আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসের একটি অংশ । এছাড়াও তিনি নিশ্চিত করে জানান, পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত ১৯ অক্টোবর কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। 

অর্থাৎ পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে অগ্নিকাণ্ডের দাবিতে ছড়ানো ভিডিওটি মূলত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একটি মহড়ার একটি দৃশ্য।

দাবি ৩

রাজধানীতে “এই মুহূর্তে” পরিকল্পিতভাবে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে দাবিতে গত ১৯ অক্টোবর রাত থেকে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়াতে দেখা গেছে। তবে ভিডিওটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনার।

ফেসবুকের একটি প্রোফাইল থেকে পোস্ট হওয়া ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা হয়, “এই মুহূর্তে রাজধানীতে ট্রেনে ভয়াবহ আগুন, সু-পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। দেশকে ভঙ্গুর করতে এটাও একটা তাদের মেডিকুলাস ডিজাইন। এই মহূর্তে দেশের মানুষকে সজাগ থাকতে হবে। দেশ ধ্বংশ করে এরা সেভ এক্সিট চাচ্ছে।” এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভিডিওটি দেড়শ বারের বেশি শেয়ার করা হয়েছে। প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে দুইশর অধিক।

উক্ত প্রোফাইল ছাড়াও ফেসবুকে একাধিক পেজ ও প্রোফাইল থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে (, , , , )

ভিডিওটির সত্যতা যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড সার্চ করে ফেসবুকে হুবহু একই দৃশ্য সম্বলিত একটি  ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি “কুমিল্লা নিউজ” নামের একটি পেজ থেকে আপলোড করা হয়। ক্যাপশনে লেখা হয়, “রাজধানীতে ট্রেনে আ’গু’ন, নি’হ’ত বেড়ে ৫”।

ঘটনাটি অধিকতর যাচাইয়ে  প্রথম আলোডেইলি স্টার সহ একাধিক সংবাদমাধ্যমে (, , , ) বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনাটি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এসকল প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ জানুয়ারি ঢাকার গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস নামের একটি ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪ জন নিহত হয়েছিল।

অর্থাৎ, ছড়ানো ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়, বরং গত বছরের জানুয়ারি মাসের। 

দাবি ৪

ঢাকার সদরঘাটে ময়ূর ৭ নামের একটি লঞ্চে আগুন লেগেছে দাবিতে দুটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, ঘটনাটি ২০২৩ সালের। 

ভিডিও ফুটেজ দুটি প্রায় একই দাবিতে সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। “প্রবাসীর নিশ্বাস” নামের ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট হওয়া ২৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা হয়, “সদরঘাটে লঞ্চে আগুন।” ভিডিওর বর্ণনায় এক নারীকণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, “গতকালকে পুড়ে ছাই হইছে এয়ারপোর্টের কার্গো সেকশন, শতশত কোটি টাকা পুইড়া ছাই হইয়া গেছে গা, বাংলাদেশের মানুষ পথে বইসা গেছে কেউ কেউ, যারা বিজনেস করে; আর আজকে দেখেন এখন আবার সদরঘাটের একটা লঞ্চে আগুন লাগছে।”

এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভিডিওটি প্রায় দেড় শ-বার শেয়ার করা হয়। প্রতিক্রিয়া জানানো হয় তিনশর অধিক।  অন্যদিকে “মাইনুল হোসাইন খান নিখিল এমপি”  নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ভিন্ন একটি ভিডিও ফুটেজ পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “ঢাকা সদরঘাটে ময়ূর – ৭ লঞ্চে আগুন —অভিশপ্ত ইউনুস! অভিশপ্ত বাংলাদেশ।” এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভিডিওটি একশর অধিক বার শেয়ার করা হয় ও সাতশর বেশি প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। 

এছাড়াও ভিডিও দুটি একাধিক ফেসবুক পেজ ও প্রোফাইল থেকেও পোস্ট করা হয় (, , ,, , , , )

ভিডিও দুটির সত্যতা যাচাইয়ে একাধিক কিফ্রেম দিয়ে সার্চ করা হলে কাছাকাছি দৃশ্যের একাধিক ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। “প্রবাসীর নিশ্বাস” নামের ফেসবুক পেজ থেকে প্রচারিত ভিডিওটির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ একটি ভিডিও পাওয়া যায় “এ জন্স প্রোডাকশন” নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে। ভিডিওটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন আপলোড করা হয়েছিল। ক্যাপশনে লেখা ছিল “সদরঘাটে এম ভি ময়ুর ৭ লঞ্চে আগুন।” 

আবার, “মাইনুল হোসাইন খান নিখিল এমপি” প্রকাশিত ভিডিওটির সঙ্গে মিল রয়েছে এমন একটি ভিডি খুঁজে পাওয়া সংবাদমাধ্যম “প্রথম আলো”র ইউটিউব চ্যানেলে। এটিও ২০২৩ সালের ৩০ জুন আপলোড করা হয়েছিল। ক্যাপশনে লেখা ছিল, “সদরঘাটে ময়ূর-৭ লঞ্চে আগুন।” এছাড়াও প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড সার্চ করে সংবাদমাধ্যমটিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনও খুঁজে পাওয়া যায়।

অধিকতর যাচাইয়ে ঘটনাটি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত কয়েকটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম নিউজ টোয়েন্টি ফোর- এর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩০ জুন ঢাকা- চাঁদপুর রুটে যাত্রীবাহী ময়ূর- ৭ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়াও, যমুনা টেলিভিশন, সময় টেলিভিশন, চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরডিবিএস নিউজেও ঘটনাটি নিয়ে ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশিত করা হয়। সবগুলো প্রতিবেদন অনুসারেই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২৩ সালের ৩০ জুন। প্রতিবেদনগুলোতে দেখানো ঘটনাস্থলের একাধিক ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে, সম্প্রতি প্রচারিত ভিডিও দুটিতে দেখানো “ময়ূর-৭” লঞ্চের কাঠামো, ডিজাইন ও পারিপার্শ্বিক দৃশ্যের মিল আছে।  

এছাড়া, ফেসবুকে কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে “ময়ুর লঞ্চ” নামের একটি ফেসবুক পেজ পাওয়া যায়। পেজটি ২০১৭ সালের “ময়ুর ৭ লঞ্চ” নামে তৈরি করা হলেও ২০২৩ সালে নাম পরিবর্ত করে কেবল “ময়ুর লঞ্চ” রাখা হয়। পেজটি থেকে একাধিক (, ) পোস্টের মাধ্যমে জানানো হয়, ময়ূর- ৭ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পুরোনো ঘটনাকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। 

অর্থাৎ, রাজধানী ঢাকার সদরঘাটে ময়ূর-৭ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের দাবিতে প্রচারিত ভিডিওগুলো পুরোনো। মূলত ২০২৩ সালের ৩০ জুন ঘটে যাওয়া ময়ূর-৭ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

আরো কিছু লেখা