সুদেষ্ণা মহাজন অর্পা

‘টরেঞ্জা’ নামের অস্তিত্বহীন দেশের নারী বলে ছড়ালো পুরোনো টিভি শো-র দৃশ্য
সুদেষ্ণা মহাজন অর্পা
যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি (জেএফকে) বিমানবন্দরে টরেঞ্জা নামের অস্তিত্বহীন এক দেশের পাসপোর্ট উপস্থাপন করছেন এক নারী এবং প্রশ্নের মুখে গায়েব হয়ে গেছেন- এমন দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে। ফ্যাক্টচেক করে দেখা গেছে, বাস্তবে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ভিডিওটি আসলে ‘এয়ারলাইন’ নামের এক পুরোনো মার্কিন টেলিভিশন শো-এর দৃশ্য, যেখানে আরবি ভাষাভাষী এক নারী ইংরেজি না জানায় বাল্টিমোর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস ফ্লাইটে সমস্যায় পড়েন। এছাড়া, ‘টরেঞ্জা’ নামের কল্পিত দেশের গল্পটিও মূলত পঞ্চাশের দশকের এক জাপানি উপকথা থেকে অনুপ্রাণিত।
গত ১১ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একটি পেজ থেকে করা পোস্টে একজন নারী ও একটি পাসপোর্টের কিছু ছবি শেয়ার করা হয়। পোস্টে ক্যাপশন দেওয়া, “আমেরিকার JFK এয়ারপোর্টে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। এক বয়স্ক মহিলা জাপান থেকে আগত প্লেন থেকে নামেন। তার পাসপোর্ট দেখে এয়ারপোর্টে স্টাফ অবাক হয়ে যান। তার দেশের নাম TORENAZA, এই নামের কোন দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে নেই।অথচ তার পাসপোর্ট এ ডজনের উপর দেশ ভ্রমণের সিল আছে যে দেশগুলো পৃথিবীতে অস্তিত্ব নেই।আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, তার পাসপোর্ট এ বায়োমেট্রিক, সিল সব কিছু অরজিনাল।তাকে যখন সব কিছু বলা হল, তিনি তখন বলেন, আমি মনে হয় অন্য গ্রহে এসেছি। তাকে একদম স্বাভাবিক ট্রাভেলারের মতই মনে হচ্ছিল। তাই এয়ারপোর্টে স্টাফ তাকে নিয়ে পযবেক্ষন রুমে রাখা হল। তিনি সেখানে ৩০ মিনিট বসে ছিলেন, হঠাত সি সি ক্যামেরা গুলো অচল হয়ে গেল। তাকে আর সেখেনে দেখা গেল না।”

পরবর্তীতে এই ছবিগুলোসহ ফেসবুক (১, ২, ৩) এবং ইনস্টাগ্রামের একাধিক ব্যবহারকারীকে একই দাবিতে পোস্ট করতে দেখা যায়।
ফেসবুক পোস্টের ছবিগুলো যাচাই করতে গেলে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে এয়ারলাইন নামের একটি টিভি শো-এর একটি ইউটিউব ভিডিও। বাংলাদেশ থেকে ভিডিওটি দেখা না যাওয়ায় ভিপিএনের সাহায্যে ভিডিওটি বিশ্লেষণ করা হয়। ভিডিওটি ছিল শো-এর “লস্ট ইন ট্রান্সলেশন” নামের একটি এপিসোডের। ভিডিওর ২২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে ছবির সেই হিজাব পরিহিত নারীকে দেখা যায়। ফেসবুক পোস্টের প্রথম ছবির সঙ্গে ভিডিওর নারীর চেহারা ও পোশাক হুবহু মিলে যায়। পোস্টের ২য় ছবিটি দেখা যায় ভিডিওটির ২৫ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডে এবং শেষ ছবিটি দেখা যায় ২৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে।

ওই এপিসোডে দেখানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর থেকে লস এঞ্জেলেসে আসা একজন নারী ইংরেজি ভাষা না জানার কারণে এয়ারলাইনের কর্মীর সঙ্গে কথা বলতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে জানা যায় তিনি আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন এবং আরবি ভাষা জানা একজন এয়ারলাইন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে তাকে সাহায্য করা হয়। এই পুরো ঘটনার কোথাও টরেঞ্জা নামক অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
তাছাড়া টরেঞ্জার দাবিতে ছড়ানো পোস্টে আরও দুটি ছবি পাওয়া যায়, যার একটিতে পরিষ্কারভাবে লেখা যে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট। অপর পাসপোর্টের দুটি পাতায় বিভিন্ন দেশের সীল দেখতে পাওয়া যায়।
ছড়িয়ে পরা ছবিগুলো নিয়ে সার্চ করতে গিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও প্রোফাইলে একটি ভিডিও (১, ২, ৩, ৪) ছড়াতেও দেখা যায়। একই ভিডিও টিকটক (১, ২, ৩,), এক্স (১, ২, ৩, ৪, ৫) এবং ইউটিউবেও (১,২,৩) ছড়াতে হতে দেখা যায়। সবগুলোর দাবি একই। মূলত বাংলাদেশের আগে অন্যান্য দেশে ভিডিও হিসেবে দাবিটি ছড়াতে দেখা গেছে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন একটি ভিডিও এই প্রতিবেদন লেখার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪৯ হাজার বারেরও বেশি শেয়ার হয়েছে। এই ভিডিও নিয়ে নিয়ে সম্প্রতি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা লিড স্টোরিজ। ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয় যে ভাইরাল ভিডিওগুলোতে পুরোনো ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটি শূন্য দশকের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এয়ারলাইন কর্মীদের নিয়ে প্রচারিত একটি টিভি শো থেকে নেওয়া হয়েছে। ভাইরাল ভিডিওতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তৈরি কণ্ঠ অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেও উল্লেখ করা হয় ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনটিতে।
জাপানি যে উপকথা থেকে অনুপ্রাণিত ‘টরেঞ্জা’ কাণ্ড
ভিডিওটি যাচাই করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম প্রাইমটাইমারের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। “টরেঞ্জা পাসপোর্টধারী নারীর গল্প সত্যি নাকি মিথ্যা? ভাইরাল দাবি খণ্ডন”- শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, টরেঞ্জার গল্প জাপানের এক শহুরে উপকথার সঙ্গে মিলে যায়। গল্পটি জাপানের বিখ্যাত “ম্যান ফ্রম টাউরেড” নামের কল্পকাহিনীর প্রেক্ষাপট টোকিওর হানেদা বিমানবন্দর ঘিরে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা এই কল্পকাহিনী নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
দাবি করা হয়, ১৯৫৪ সালের গ্রীষ্মে দেখতে ইউরোপিয়ান মনে হয়- এমন এক ব্যক্তি টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরে পৌঁছে পাসপোর্ট বের করলে দেখা যায়, তার দেশের নাম টাউরেড। জাপানি কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যান, কারণ মানচিত্রে এমন কোনো দেশ কখনোই ছিল না। ফ্রেঞ্চ ও জাপানিজ ভাষায় দক্ষ ওই ভ্রমণকারী জোর দাবি করেন টাউরেড দেশটি ফ্রান্স ও স্পেনের মাঝখানে অবস্থিত এবং তার দেশ হাজার বছরের পুরোনো।

তার পাসপোর্টে অনেক দেশের এমনকি জাপানের স্ট্যাম্পও ছিল। তদন্তে দেখা যায়, তার ভ্রমণের উদ্দেশ্য, হোটেল বুকিং, এমনকি ব্যাংক সবই অস্তিত্বহীন। তাকে একটি হোটেলে নজরদারিতে রাখা হয়, কিন্তু পরদিন সকালে ওই ব্যক্তি ও তার সমস্ত নথিপত্র রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। এ ঘটনার কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড বা সংবাদ প্রতিবেদন কখনো পাওয়া যায়নি, তবু এটি জনপ্রিয় এক উপকথায় পরিণত হয়েছে।
দাবি করা হয়, “টাউরেডের পুরুষ” নামে পরিচিত এই কিংবদন্তিটি সম্ভবত ১৯৫৯ সালের একটি বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে তৈরি। জন অ্যালেন কুচার জেগ্রাস নামে এক শ্বেতাঙ্গ তার কোরিয়ান স্ত্রীকে নিয়ে জাপানে যান এবং পরে জাল পাসপোর্ট ব্যবহার ও পরিচয় জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।
জাপানি সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, জেগ্রাস এক প্রাক্তন গুপ্তচর; সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে জাপানি সামরিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের কাজ করছিলেন। ১৯৬০ সালে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সাজা শেষে জেগ্রাসকে হংকংয়ে এবং তার স্ত্রীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়।
তাদের পরবর্তী জীবনের কোনো তথ্য আর জানা যায়নি। এই রহস্যজনক ঘটনার পরই টাউরেড কিংবদন্তি জাপানে ছড়িয়ে পড়ে।