তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন

আওয়ামী লীগের মিছিলে ভিড় বাড়িয়ে দেখানো হলো এআই দিয়ে
তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন
সামাজিক মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণা নতুন নয়। মিছিল, সভা-সমাবেশ কিংবা আন্দোলনের প্রচারে এআইয়ের ব্যবহার হয়েছে নানা সময়। তবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের বাস্তব মিছিলে স্বল্পসংখ্যক মানুষের উপস্থিতির ভিডিও এআইয়ের মাধ্যমে সম্পাদনা করে উপস্থিতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। কোনো এআই লেবেল কিংবা ভিডিও সম্পাদনায় এআই ব্যবহারের উল্লেখ না থাকায় সাধারণ ব্যবহারকারীদের অনেকেই এই ভিডিওকে আসল বলে ধরে নিচ্ছেন। ২০২৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে গণবিক্ষোভ সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা গঠনে এআই-নির্মিত ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
এআই সম্পাদনায় বানানো মিছিলের ভিডিও ভাইরাল ফেসবুকে
“শেখ হাসিনা আসবে, বাংলাদেশ হাসবে” লেখা ব্যানার নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের মিছিলের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বিবরণে লেখা, “আমরা সবাই শহীদ হবো শেখ হাসিনাকে দেশে আনবো আওয়ামী লীগের মিছিল।” ভিডিওতে একদল মানুষকে, “আমরা সবাই শহীদ হবো, শেখ হাসিনাকে দেশে আনবো”, “শেখ হাসিনার কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে”, “শেখ হাসিনার কিছু হলে, যুদ্ধ হবে বাংলাদেশে” স্লোগান দিতে দিতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ব্যানারে বিশাল মিছিল সামনে এগিয়ে যেতে দেখা যায়।
ঢাকা ১১ আসন আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত মিছিলের এই ভিডিও ‘হোসেইন সাদ্দাম’ নামের একটি পেজ থেকে ছড়ানো হয়। পোস্টে একজন মন্তব্য করেন, “শেখ হাসিনা আসবে বাংলাদেশে আসবে ইনশাআল্লাহ জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু দাবি রাখতে পারবে না কোন রাজাকার কোন আল বদর” (বানান অপরিবর্তিত)। ভিডিওটি দেড় হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে এবং পৌনে চার লাখের মতো ব্যবহারকারী এটি দেখেছেন। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, ভিডিওটি আসল নয়; এআই দিয়ে তৈরি।
কিফ্রেম সার্চে দেখা যায়, একই ফুটেজ নিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্পাদিত একাধিক ভিডিও এর আগেও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পেজ ও প্রোফাইল থেকে ছড়িয়েছিল। ১৭ এপ্রিল নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের ছবি ব্যবহার করে তৈরি সেই হোসেইন সাদ্দাম নামের পেজটি থেকেও ১৬ সেকেন্ডের ভিডিও ছড়ানো হয় যা তখন তিন লাখের বেশি ব্যবহারকারী দেখেছে। ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, “আজকে তো সবে মাত্র শুরু হল। এটা তো ট্রেইলার মাত্র, পিকচার আবি বাকি হে মেরা দোস্ত…।” একই দিনে একই ফুটেজ সম্পাদনার মাধ্যমে দীর্ঘায়িত করে “নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপি” নামের এক ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ৩১ সেকেন্ডের ভিডিও শেয়ার করা হয়। ভিডিওটিতে “মহাপ্রলয়, জয় বাংলার জয়” গানটি যুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ ও ভোলা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। এছাড়া “আপাসোসাইটি” নামের টিকটক পেজ থেকেও ভিডিওটি শেয়ার করা হয়। তবে টিকটকের ভিডিওতে “জয় বাংলা, জিতবে এবার নৌকা” গানটি যুক্ত করা ছিল।
ভিডিওটি ফ্যাক্টচেক করতে ডিসমিসল্যাব কিফ্রেম সার্চ করে। কিফ্রেম সার্চে একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে (১, ২, ৩) এ ঘটনার মূল ভিডিওটি পাওয়া যায়। সবগুলো প্রতিবেদনই প্রকাশিত হয় গত ১৫ এপ্রিল। চ্যানেল টুয়েন্টিফোর তাদের ভিডিও প্রতিবেদনে লিখেছে, “ঢাকায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল”।
“বাংলা অ্যাফেয়ার্স” নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “রাজধানীর রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে আজ মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) সকাল সাড়ে সাতটায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাজহার আনামের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।”
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ইউটিউব ভিডিওর ব্যানারে লেখা স্লোগান, আয়োজকদের পরিচয়, ডিজাইন, শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওগুলোর হুবহু মিল পাওয়া যায়। ব্যানার ধরে মিছিল করা ব্যক্তিদের পোশাকের রঙও একই। তাছাড়া, ভিডিও দুইটিতে দৃশ্যমান দূরের সুউচ্চ ভবন, নির্মাণাধীন ফুট ওভারব্রিজ, টাওয়ার, রাস্তার পাশের বিদ্যুতের স্তম্ভ ও তাতে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রাখা ব্যানার ভাইরাল ভিডিওগুলোর সঙ্গে মিলে যায়।
তবে গণমাধ্যমের এই ভিডিওগুলোর সঙ্গে ব্যাপক মানুষের মিছিল দাবিতে ছড়ানো সম্পাদিত ভিডিওগুলো তুলনা করলে স্পষ্ট কিছু পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। মূল ভিডিওতে ব্যানারের সামনে লাল ও কালো পোশাক পরিহিত দুইজন পুরুষ হলেও ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তাদের উপস্থিতি নারী হিসেবে। দুইপাশ থেকে এগিয়ে যাওয়া এই দুইজনের দেহের অস্বাভাবিক পরিবর্তনও দেখা যায়। জুম করে দেখলে মিছিলের অনেক মানুষের মুখ অস্পষ্ট, বিকৃত ও অঙ্গভঙ্গি অস্বাভাবিক দেখায়। মূল ভিডিওতে রাস্তার দুই লেন ও তাতে চলাচল করা বাসের নাম ও রঙ স্পষ্ট। কিন্তু যাচাই করা ভিডিওতে এসব অস্পষ্ট। মূল ভিডিও দুইটিতে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের স্লোগান শোনা যায়। অন্যদিকে বাকি সম্পাদিত ভিডিওগুলোতে মূল ভিডিওর সাউন্ডের পরিবর্তে ভিন্ন কোনো স্লোগান বা গান যুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া মূল ভিডিওতে মিছিলের সারিগুলোর ঘনত্ব মাঝারি, মানুষের মাঝে ফাঁকা জায়গা স্পষ্ট। তাছাড়া মিছিলে সারির সংখ্যাও কম এবং পেছনের সারিগুলোতে মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে আরও কমে গেছে। অন্যদিকে, সম্পাদিত ভিডিওতে রাস্তা লোকে লোকারণ্য, মিছিলে মানুষের মাঝে ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। মূল ভিডিওতে মিছিলে লোকসংখ্যা শ খানেকের কম, সেটাই বহুগুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে।
অর্থাৎ, সম্পাদিত ভিডিওর সঙ্গে মূল ফুটেজের একাধিক অসঙ্গতি পাওয়া যায়। চরিত্রগুলোর লিঙ্গ পরিবর্তন, দেহের অস্বাভাবিক বিকৃতি, অস্পষ্ট ও বিকৃত মুখাবয়ব, পরিবহন সম্পর্কিত স্পষ্ট তথ্য গায়েব হওয়া ও স্লোগান পরিবর্তন এবং মিছিলে দেখা যাওয়া অস্পষ্ট অবয়বের বাড়তি লোক —এসবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দ্বারা ভিডিওটি সম্পাদিত বা তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ, মূল ভিডিও কিংবা এর থেকে নেওয়া ক্লিপ ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তির সাহায্যে কৃত্রিমভাবে মিছিলের লোক সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
অধিকতর যাচাইয়ের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় তৈরি কন্টেন্ট শনাক্তকারী টুল এআইঅরনট ব্যবহারেও একই ফলাফল দেখা যায়।

গবেষণায় প্রমাণ, এআই দিয়ে বানানো কন্টেন্ট মানুষের ধারণা বদলাতে সক্ষম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি ছবি রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলনের ভিড়ের আকার সম্পর্কে মানুষের ধারণা কার্যকরভাবে পরিবর্তন করতে পারে কিনা তা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণায় ছবির বিকৃতির কার্যকারিতা যাচাই করতে একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব কন্সটেনজের স্টিফেন স্কোলজ ও নিলস বি উইডম্যানের ২০২৫ সালের এই গবেষণায় চিলি ও লেবাননের আটটি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনার ৮১৪টি আসল ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি ঘটনার অন্তত ১০টি ছবি রয়েছে। এরপর সেগুলো এআই-ভিত্তিক সেগমেন্টেশন ও ডিফিউশন মডেলের মাধ্যমে পরিবর্তন করে ভিড় বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানো হয়েছে।
এরপর অংশগ্রহণকারীদের প্রতিবাদ কর্মসূচির ছবি দেখানো হয়েছে—যার মধ্যে কখনো আসল ছবি, আবার কখনো জেনারেটিভ মডেল দ্বারা পরিবর্তিত ছবি ছিল। গবেষণার ফল বলছে ছবি বিকৃতি কাজ করে। এআইয়ের মাধ্যমে বড় (বা ছোট) করে উপস্থাপিত ভিড় আসল ছবির তুলনায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি (বা কম) জনসমাগমের ধারণা তৈরি করেছে।
গবেষকদের মতে, “রাজনৈতিক সমাবেশ বা আন্দোলনে ভিড়ের আকার রাজনৈতিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি কোনো শাসন ব্যবস্থা বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ইস্যুর প্রতি জনসমর্থনের মাত্রা বুঝিয়ে দেয়। জনগণের কাছে ভিড়ের আকার কেমন মনে হচ্ছে- এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের আগ্রহের বিষয়। কেউ ভিড়ের আকার কমিয়ে আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন জাগাতে চায়, আবার কেউ তা বাড়িয়ে দেখায় আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে।”
সেখানে আরও বলা হয়, “ভিড়ের আকার বাড়ানো বা কমানোর একটি উপায় হলো সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো। বিশেষ করে, পরিবর্তিত ভিজুয়াল কন্টেন্ট বেশ কার্যকর, কারণ বাস্তব ঘটনার প্রমাণ হিসেবে ছবি ও ভিডিও এখনো বিশ্বাসযোগ্য এবং এগুলোর সত্যতা যাচাই অনেক সময় কঠিন। বর্তমানে আধুনিক জেনারেটিভ মডেলগুলো বৃহৎ পরিসরে ছবি বিকৃত করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এআই-সৃষ্ট এসব ছবির সঙ্গে মূল ছবির পার্থক্য প্রায় নেই বললে চলে এবং এগুলো ব্যবহার করে জনসমাগমকে হয় বড় আকারে, নয় ছোট আকারে উপস্থাপন করা সম্ভব।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এআই ভিডিওর ব্যবহার
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আন্দোলন বা সমাবেশের ছবি ও ভিডিও তৈরির এই প্রবণতা রাজনীতির ময়দানে নতুন নয়। কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণ দেখানো একটি ভিডিও পরে ফ্যাক্টচেকে এআই দিয়ে তৈরি বলে ধরা পড়ে। ভিডিওটিতে একদিকে মানুষের মুখাবয়বে অস্পষ্টতা, একই ফিগারের পুনরাবৃত্তি, সমাগমের অস্বাভাবিক মসৃণ গতি ও স্থির গাছপালা—সব মিলিয়ে স্পষ্ট এআইয়ের চিহ্ন ছিল। অপরদিকে গণমাধ্যম ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী সেদিন সিডনি, অ্যাডিলেইড, মেলবোর্নসহ বিভিন্ন শহরে হওয়া সমাবেশগুলোর আকার ছিল অনেক ছোট। সেসব এলাকার কোনো স্থানের সঙ্গে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর স্থানের মিল পাওয়া যায়নি।
তার আগে চলতি বছরের আগস্টে ইন্দোনেশিয়ার সংসদ ভবন ঘিরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলাকালে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো এক ভিডিও প্রথমে “হাজারো শিক্ষার্থীর মিছিল” হিসেবে প্রচারিত হলেও পরে এএফপি ফ্যাক্ট চেক নিশ্চিত করে যে সেটি এআই দিয়ে তৈরি। ভিডিওতে ব্যানারে অর্থহীন লেখা, বিকৃত মুখাবয়ব আর অস্বাভাবিকভাবে চলা যানবাহন—এসব স্পষ্টভাবে এআই-সিন্থেটিক ভিজ্যুয়ালের বৈশিষ্ট্য বহন করছিল।
বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি ও সম্পাদিত ভিডিও
বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের মিছিলের দাবিতে বিভিন্ন সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি ভিডিও ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায় একাধিক সামাজিক মাধ্যমে।
ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানারের একাধিক প্রতিবেদনে ঢাকা বা চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের মিছিল, নদীপথে নৌকার মিছিল, জয় বাংলা স্লোগানে সাধারণ মানুষের রাস্তায় নেমে আসার মিছিল, জামায়াত-শিবির বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল এর এআই ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে। মিছিলে থাকা ব্যক্তিদের মুখের সঙ্গে স্লোগানের অমিল ও মুখভঙ্গির অসংগতি, মিছিলে কিছু ব্যক্তিকে হুট করে আরেক ব্যক্তির শরীরে মিশে যেতে দেখা, একাধিক ব্যক্তি মিলে একজনে পরিণত হওয়া কিংবা রাস্তায় গাড়ির নড়াচড়ায় অসংলগ্নতা, মিছিলের ব্যানারগুলোর লেখা বিকৃত হওয়ার মতো অসংগতি খুঁজে পাওয়া যায় ভিডিওগুলোতে।

সামাজিক মাধ্যমে একাধিক আইডি (১, ২) থেকে এ বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এ ধরনের কৃত্রিম মিছিলের ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের মে মাসে গুগল ডিপমাইন্ড ভিও ৩ উন্মোচন করে। নতুন সংস্করণে শুধু টেক্সট নয়, বরং ছবি থেকে ভিডিও তৈরির সুবিধা যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি ভিডিওর সঙ্গে অডিও জেনারেশনও সম্ভব হয়েছে কিংবা চাইলে আলাদা করে অডিও যোগ করার সুবিধাও রয়েছে।
আগের ছড়িয়ে পড়া এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওগুলোর সঙ্গে ‘হোসেইন সাদ্দাম’ নামের পেজ থেকে ঢাকা ১১ আসন আওয়ামীলীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত মিছিলের ভিডিওর কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য এআই ভিডিওতে মিছিলের আশেপাশের স্থাপনার অবস্থান বা ধরন ও গাছপালার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায় এরকম বাস্তব কোনো এলাকা পাওয়া যেত না। কিন্তু এই এআই ভিডিওর ভবন, ওভারব্রিজ, টাওয়ার, তাদের অবস্থান মূল ভিডিও-র সঙ্গে মিলে যায়। তাছাড়া, এআই সাধারণত কোনো লেখার ক্ষেত্রে যে বিকৃতি ঘটায় তা এই ভিডিওতে হয়নি। এখানে ব্যানারে লেখা স্লোগান, আয়োজকদের নাম, ছবি, ডিজাইন কোনো কিছুই বিকৃত হয়নি। অর্থাৎ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি এই ভিডিওটি বাস্তবতার আরও কাছাকাছি।
প্রযুক্তি কোম্পানির নীতি ও সতর্কবার্তা
এআই সেফটি কোম্পানি কনজেকচারের সিইও কনর লিহি সংবাদমাধ্যম টাইমকে বলেন,“ডিপফেক ও সিনথেটিক মিডিয়া থেকে আসা ঝুঁকিগুলো বহু বছর ধরে সুপরিচিত এবং স্পষ্ট। তবুও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুপরিচিত ও স্পষ্ট ঝুঁকিগুলোর বিরুদ্ধেও কার্যকরভাবে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। এটি একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা যে তারা আরও বিপজ্জনক, নিয়ন্ত্রণহীন এআই ও এজিআই পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট দায়িত্বশীল নয়।” এছাড়া এ ধরনের সুস্পষ্ট দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের রাশ টানা হচ্ছে না বা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না—এটা অনিবার্যভাবে বিশ্বজুড়ে নিরীহ মানুষের জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে বলেও জানান তিনি।
তবে এআইয়ের মাধ্যমে বানানো কন্টেন্ট ও বিকৃত (ম্যানিপুলেটেড) কন্টেন্ট লেবেল করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে মেটা। সেখানে বলা হচ্ছে এআই-চিহ্নিত ছবি মেটা শনাক্ত করলে অথবা কেউ যদি প্রকাশ করে যে তারা এআই দিয়ে বানানো কনটেন্ট আপলোড করছে, তখন মেটা সেই কন্টেন্টকে “এআই দ্বারা তৈরি” হিসেবে লেবেল করবে। পরবর্তীতে বলা হয়, কোনো পোস্ট বা কন্টেন্ট কেবল এআই টুল দিয়ে এডিট বা পরিবর্তন করা হয়ে থাকে (পুরোপুরি নতুন কন্টেন্ট নয়), তাহলে “এআই ইনফো” লেবেলটি সরাসরি পোস্টের উপর দেখানো হবে না, বরং পোস্টের মেন্যুতে রাখা হবে। অর্থাৎ, ব্যবহারকারী চাইলে মেনুতে গিয়ে দেখতে পারবে পোস্টটি এআই দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে কি না। যদি কোনো কনটেন্ট সম্পূর্ণভাবে এআই টুল দ্বারা তৈরি হয়, তাহলে “এআই ইনফো” লেবেল সরাসরি পোস্টের সঙ্গে দেখানো হবে।
অন্যদিকে, টিকটক চায় যে নির্মাতারাই সেই কন্টেন্টগুলোতে লেবেল যোগ করবে যা এআই-দ্বারা তৈরি বা বড়ভাবে সম্পাদিত এবং যেখানে বাস্তবসম্মত দৃশ্য বা মানুষ দেখানো হয়েছে। যদি কোনো কনটেন্টে লেবেল না থাকে, তাহলে সেটা ক্ষতির মাত্রা অনুযায়ী টিকটক টিম সরিয়ে ফেলতে পারে, সীমিত করতে পারে, বা নিজেরাই লেবেল যোগ করতে পারে। ২০২৪ এর মে মাসে টিকটক জানায়, তারা এখন কিছু নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম থেকে আপলোড করা এআই-তৈরি কন্টেন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেবেল করা শুরু করেছে। এর আগে, টিকটক শুধু নিজের এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি কন্টেন্ট লেবেল দিত এবং নির্মাতাদের বলা হত যেন তারা বাস্তবসম্মত এআই সম্বলিত অন্য যেকোনো কনটেন্টেও ট্যাগ যোগ করে।
অথচ ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া আওয়ামী লীগের মিছিলের ভিডিওটিতে এরকম কোনো লেবেল খুঁজে পাওয়া যায়নি, পাওয়া যায়নি টিকটকেও। অ্যাডা লাভলেস ইন্সটিটিউটের গবেষক জুলিয়া স্ম্যাকম্যান বলেন, “টেকনোলজি কোম্পানিগুলোর বর্তমান প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ‘সেফটি ক্লাসিফায়ার’ যথেষ্ট নয়, কারণ তা ক্ষতিকর ছবি ও ভিডিও তৈরি থামাতে পারছে না।” তিনি আরও বলেন, “এখন পর্যন্ত, ডিপফেক ভিডিও অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে ব্যবহৃত হওয়া প্রতিরোধ করার একমাত্র কার্যকর উপায় হলো এমন মডেলের অ্যাক্সেস সীমিত করা এবং আইন প্রণয়ন করা। যা নিশ্চিত করে যে সেই মডেলগুলো নিরাপত্তার শর্ত পূরণ করছে এবং সেগুলোর অপব্যবহার কার্যকরভাবে রোধ করছে।”
২০২৪ সালে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের এআই নীতি আপডেট সম্পর্কে ইইউ ডিসইনফো ল্যাবের সিনিয়র গবেষক রাকেল মিগুয়েল তার পর্যবেক্ষণে জানান, “শুধু লেবেলিং বা চিহ্নিতকরণ দিয়েই এআই প্রযুক্তির কারণে সৃষ্ট সব ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায় না বরং এটি অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার পরিপূরক হওয়া উচিত। তাছাড়া ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক কন্টেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া থেকে প্ল্যাটফর্মগুলোকে বিরত রাখা উচিত নয়।” তিনি মনে করেন, প্ল্যাটফর্মগুলো দায়িত্বের বোঝা ব্যবহারকারীদের (যেমন ইউটিউবের ক্ষেত্রে) বা কন্টেন্ট লেবেলিংয়ের জন্য এআইয়ের উপর দায় চাপিয়ে চলেছে। মিগুয়েল আরও উল্লেখ করেছেন, “স্বয়ংক্রিয়ভাবে সনাক্তকরণের জন্য খুব কম প্রচেষ্টা করা হয়। যার ফলে এমন কন্টেন্টের ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়ে যায় যা প্রযুক্তি বা ব্যবহারকারী কারোর পক্ষেই চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।”