নোশিন তাবাসসুম

আগুন লাগা সিংহ দরবারে নয়, চর্যাপদ সংরক্ষিত নেপালের জাতীয় আর্কাইভে
নোশিন তাবাসসুম
নেপালের সিংহ দরবারে অগ্নিসংযোগের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, চর্যাপদের মূল পাণ্ডুলিপি সেখানে সংরক্ষিত ছিল। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, চর্যাপদের মূল পাণ্ডুলিপি নেপালের সিংহ দরবারে সংরক্ষিত থাকার দাবিটি ভিত্তিহীন। একাধিক উৎস বিশ্লেষণ করে জানা যায়, প্রাচীন এই পুঁথিটি সংরক্ষিত আছে নেপালের জাতীয় আর্কাইভে।
অভিনেতা রওনক হাসানের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সিংহ দরবারে অগ্নিসংযোগের ছবি শেয়ার করা হয়। পোস্টের বিবরণে লেখা, “চর্যাপদের মূল পান্ডুলিপি এখানে সংরক্ষিত ছিলো !!!!!!!!” ফেসবুকের একাধিক প্রোফাইল (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬) ও পেজ থেকে গত ১১ সেপ্টেম্বর একই দাবিতে ছবিটি শেয়ার হতে দেখা যায়। ইনস্টাগ্রামের একটি প্রোফাইল থেকেও চর্যাপদ পুড়েছে দাবিতে সিংহ দরবারের ছবি পোস্ট করা হয়। বিবরণে লেখা, “একটা জাতিকে ১০০০ বছর পিছিয়ে দিতে তাদের লাইব্রেরিগুলো পু’ড়িয়ে দিলেই যথেষ্ট! পু’ড়ছে নেপালের রয়াল লাইব্রেরি, পু’ড়ছে চর্যাপদ!”

ছড়িয়ে পড়া ছবিটির ভেতরে লেখা, “এটা করা উচিত হয়নি আমাদের। সিংহ দরবার একসময় এশিয়ার অন্যতম সুন্দর প্রাসাদগুলোর একটি ছিল। আমাদের ইতিহাসের সমৃদ্ধ অংশ। এর ঐতিহ্যের অনেকটাই হারিয়ে গেল।”

ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড সার্চে “Mamun Rashid (মামুন অর রশীদ)” নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে এ সম্পর্কিত একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। সিংহ দরবারে অগ্নিকাণ্ড ও সে ঘটনার সঙ্গে চর্যাপদ পুঁথিকে জড়ানো প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই গবেষক ও শিক্ষক তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “চর্যাপদ নেপালের সিংহদরবারে রয়েছে, এবং সেই দরবার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে – এমন অনেক পোস্ট দেখতে পাচ্ছি। সিংহ দরবার পুড়িয়ে দেওয়া হলেও দরবারে পুথি থাকার তথ্যটি ভুল। চর্যাপদের তালপাতার পুথিটি নেপালের সিংহ রাজদরবারে নেই। সেটি যে আর্কাইভে রক্ষিত তা ঠিকঠাক আছে অদ্যাবধি।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিষয়টি তাঁকে নিশ্চিত করেছেন তাঁর নেপালি বন্ধু তারামণি বায়। চর্যাপদ নিয়ে কিছু গবেষণাও রয়েছে এই শিক্ষকের।

ছবিটির কিফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে দেখা যায়, ছবিটি গত ৯ সেপ্টেম্বরে সিংহ দরবারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার। নেপালে সরকারবিরোধী আন্দোলন সহিংস রূপ নিলে বিক্ষোভকারীরা প্রাসাদটিতে সেদিন অগ্নিসংযোগ করে।
ঘটনাটি সম্পর্কে যাচাইয়ে নেপালের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান “নেপাল ফ্যাক্টচেক” এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিসমিসল্যাব। প্রতিষ্ঠানটির এডিটর উমেশ শ্রেষ্ঠ জানান, নেপালে চলমান বিক্ষোভে সিংহ দরবারসহ বেশ কিছু সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হলেও কোনো জাতীয় গ্রন্থাগার বা আর্কাইভ পোড়ানোর ঘটনা তিনি শোনেননি। উমেশ আরও জানান, তরুণদের কিছু সংগঠন জাতীয় আর্কাইভ পাহারা দিয়েছে এবং বিক্ষোভকারীদের এই স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত করা থেকে প্রতিহত করেছে। উমেশ জানান, নেপালের জাতীয় আর্কাইভের পাণ্ডুলিপি বিভাগের একজন কর্মকর্তা, মানিতা নেউপানে নিশ্চিত করেছেন, চর্যাপদসহ সকল পাণ্ডুলিপি নিরাপদে আছে।
আর্কাইভ পাহারা দেওয়ার এই তথ্য তুলে ধরে গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজ অব নেপাল। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কিছু সরকারি স্থাপনাতে আগুন দেয়া হলেও, জাতীয় আর্কাইভে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। জেন-জি আন্দোলনকারীরা সেখানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করলে অ্যাক্টিভিস্ট, তিনটি নিরাপত্তা সংস্থা, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং আর্কাইভের প্রাক্তন কর্মীরা একসঙ্গে তা প্রতিহত করে। এছাড়া এই প্রতিবেদন প্রকাশের একদিন আগে, অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হওয়া উকালোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯ সেপ্টেম্বর দিনভর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে তিনবার হামলা হয়েছিল। প্রথমবারে তালা ভেঙে ফেলা হয়। দ্বিতীয়বার সাত–আট জন হামলা করতে এলেও তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। তৃতীয় হামলার আগে ব্যারিকেড স্থাপন করা হয় এবং পোস্টার টাঙিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়।
অর্থাৎ, চর্যাপদের মূল পাণ্ডুলিপি নেপালের সিংহ দরবারে সংরক্ষিত ছিল দাবিতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দাবিটি ভিত্তিহীন।
প্রসঙ্গত, চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য এবং সাহিত্য নিদর্শন। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে সর্বপ্রথম চর্যাপদের একটি পুঁথি উদ্ধার করেন।

