তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
ছুরিকাঘাতে হত্যার ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়

ছুরিকাঘাতে হত্যার ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়

তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

একাধিক ব্যক্তিকে গলা কেটে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হচ্ছে– এমন দৃশ্যের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটি শেয়ার করে কোথাও বলা হয়েছে, এটি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের, আবার কোথাও দাবি করা হয়েছে এটি মিয়ানমারের আরাকানে আরাকান আর্মির হাতে রোহিঙ্গা হত্যার। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, মূল ঘটনাটি ২০২৩ সালে মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন সান্নি ন্যাশনালিটিজ আর্মির (এসএনএ) হাতে কয়েকজনকে হত্যার ভিডিও; এর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একজন সামরিক ও একজন বেসামরিক পোশাকধারী ব্যক্তি কয়েকজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করছে। ভিডিওটি শেয়ার করে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “বাংলাদেশের ভিতরে আদিবাসী সশস্ত্র সংগঠনের ভয়ে করিডর দেওয়া হবে।” শেয়ার করা ঐ ভিডিওতে লেখা, “আমার সোনার বাংলা এখন জঙ্গি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে।” পোস্টটি এখন পর্যন্ত ৭৩ হাজারের বেশিবার দেখা হয়েছে। অপরদিকে রোহিঙ্গা গণহত্যার দৃশ্য দাবি করে একই ভিডিও শেয়ার করতে দেখা গেছে বেশ কয়েকজন ব্যবহারকারীকে। একাধিক ফেসবুক ব্যবহারকারী (, , ) লিখেছেন, “মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে আরাকান আর্মিরা” কিংবা “আরা’কানে রো’হি’ঙ্গা মুসলিমদের হ’/ত্যা” (বানান অপরিবর্তিত)। 

ঘটনাটি বাংলাদেশের কি না তা যাচাইয়ের জন্য ভিডিওটির কিফ্রেম ধরে অনলাইনে সার্চ করলে মিয়ানমারের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে যুক্ত ছবির সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের বা মিয়ানমারের আরাকানের দাবিতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির ফুটেজে হুবহু মিল পাওয়া যায়। দ্যা সেভেন্টি ফোর মিডিয়া নামে মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থার ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, এই ঘটনা ঘটেছিল মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে। ভিডিওতে সামরিক পোশাক পরিহিত ব্যক্তির হাতে সান্নি ন্যাশনালিটিজ আর্মির (এসএনএ) আর্মব্যান্ড আছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে সেভেন্টি ফোর মিডিয়ার প্রতিবেদনে। এ থেকে বোঝা যায়, হত্যাকরী ব্যক্তিরা এসএনএ-এর সদস্য, আরাকান আর্মি নয়। 

সেই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনের ভাষ্য তুলে ধরে পরবর্তীতে সংবাদ প্রকাশ করে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী। এই প্রতিবেদনেও যে ছবিগুলো যুক্ত করা হয়েছে, তার সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের দৃশ্য দাবিতে ছড়ানো ভিডিওর হুবহু মিল পাওয়া যায়। ইরাবতীর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাচিন রাজ্যের হপাকান্ট শহরের দক্ষিণে সেজিন গ্রামে সামরিক কাউন্সিলের হাতে আটক হওয়ার কয়েক মাস পর তাদের সশস্ত্র ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেয়া হয়। তিনি সেই সশস্ত্র লোকদের ভাষা শুনে তাদের এসএনএ হিসেবে শনাক্ত করেন। তিনি জানান, সেদিন ছিল ১৯ জানুয়ারী, ২০২৩।

সেজিন গ্রামটি হোমালিন টাউনশিপ ও কাচিন রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত, যার বেশিরভাগই সান্নি জাতিগত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এসএনএ গোষ্ঠীটিও কাচিন রাজ্য ও সেজিন অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়। অন্যদিকে রোহিঙ্গারা মূলত রাখাইন বা আরাকানের অধিবাসী। আরাকান মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলে, বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। অন্যদিকে কাচিন মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে চীন ও ভারতের সীমান্ত-ঘেঁষা একটি পাহাড়ি অঞ্চল।

সেজিন গ্রামের কাছে একটি এসএনএ ক্যাম্পে আক্রমণ করে সেটির দখল নিয়েছিল কেপিডিএফ (কাচিন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স) ও কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ)। সেসময় এসএনএ সৈন্যদের ফোন থেকে উল্লিখিত ভিডিও ক্লিপগুলো সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে কেপিডিএফের একজন কর্মকর্তা এটি ইরাবতীকে পাঠান। 

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের জুনের শেষ থেকে কাচিন রাজ্যের হপাকান্ত টাউনশিপের সেজিন গ্রামে কেআইএ, পিডিএফ ও সামরিক কাউন্সিলের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। আগস্টের শুরুতে কেআইএ ও পিডিএফ যৌথভাবে সামরিক ক্যাম্প, পুলিশ স্টেশন ও সেজিনের কাছে একটি এসএনএ ঘাঁটি দখল করে। এর জবাবে সামরিক বাহিনী স্থল ও আকাশ থেকে হামলা চালায়। ইরাবতী স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানায়, অভিযানে এসএনএ সেনারাও যুক্ত ছিল, যদিও তারা তা অস্বীকার করে। এ হামলায় গ্রামের কয়েকজন পালাতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তাদেরই কয়েক মাস পর এসএনএ-এর হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং ঐ হত্যাকান্ড ঘটে। 

অর্থাৎ, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের বা মিয়ানমারের আরাকানে আরাকান আর্মির হাতে রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনা বলে দাবি করা ভিডিওটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মূলত এটি মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের সশস্ত্র সংগঠন এসএনএ-এর হাতে জান্তা-বিরোধী সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য সন্দেহে হত্যাকান্ডের ভিডিও।

আরো কিছু লেখা